ভাড়া কম, তাই মৃত্যুঝুঁকিতে বসবাস

চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজারের মতিঝর্ণা টাঙ্কির পাহাড়ে উঠার সিঁড়ির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দুইপাশে তাকালেই চোখে পড়ে বহুতল ভবন ও আধপাকা ভবনের টিনের ছাদ।

মিন্টু চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 June 2014, 11:53 AM
Updated : 11 June 2014, 12:42 PM

পাহাড়ের ঢালের প্রায় পুরোটাই ঢেকে গেছে অবৈধ এসব স্থাপনায়। স্থাপনার আড়ালে এখনো চলছে পাহাড় কেটে ঘর বাড়ি বানানোর কাজ, যা টের পাওয়া যায় শুধু ধসে প্রাণহানির পর।

২০০৭ সালের ১১ জুন মধ্যরাতে প্রবল বর্ষণের পর নগরীর অন্য ছয় স্থানের মতই পাহাড় ধস হয় মতিঝর্ণা এলাকায়। মারা যায় দুইজন। অদূরে লালখান বাজারের কুসুমবাগ এলাকায় পাহাড় ধসে প্রাণহানি হয় সাত জনের।

এরপর বছর না ঘুরতেই ২০০৮ সালের ১৮ অগাস্ট টাঙ্কির পাহাড়ের পূর্ব অংশে আবার পাহাড় ধসে মারা যায় ১২ জন।

২০১৩ সালের ২৮ জুলাই ভোরে টাঙ্কির পাহাড়ের পশ্চিম অংশে পাহাড় ধসে নিজ ঘরেই মাটিচাপায় নিহত হন পোশাক কর্মী ফাতেমা (৩৫) ও তার মেয়ে কুলসুম (১৭)।

১৫ বছর ধরে ওই পাহাড়ে ছিলেন ফাতেমা-কুলসুমরা। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ধসে প্রাণহানি দেখলেও ঘর না ছাড়ায় পাহাড়ের মাটিতে চাপা পড়েন তারা।

ফাতেমার প্রতিবেশী শাহনাজের ঘরের ‍চালার একাংশও মাটি চাপা পড়ে। ফাতেমার আর্তনাদে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে প্রাণে বাঁচেন তিনি।

সেই শাহনাজও এখনো ছাড়েননি পাহাড়ের ঘর। এরকম শত শত পুরনো বাসিন্দার পাশেই পাহাড় কেটে তোলা নতুন ঘরে ঠাঁই খুঁজে নেন নতুনরা।

শুধু লালখান বাজারের মতিঝর্ণা নয়, নগরীর আকবর শাহ, টাইগার পাস, বাটালি হিলে প্রতি বছরই ধসছে পাহাড়, ঘটছে অকাল মৃত্যু।

মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারেনি পাহাড়ের ঢালে বসবাস। ঘটনার কিছুদিন পরেই আবারো সেখানে বসতি তৈরি করে চলছে তাদের বসবাস।

মাটিচাপায় পাঁচ স্বজনের মৃত্যুর স্মৃতি নিয়েই টাইগারপাসের বাটালি হিলের ঢালে ঘর বানিয়ে থাকছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব বাচ্চু মিয়া। ২০১১ সালের ১ জুলাই পাহাড় ধসে যে ১৭ জনের মৃত্যু হয় তাদের মধ্যে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও চার ছেলে-মেয়েও ছিল। বাটালি হিলের সুরক্ষা দেয়াল ও পাহাড়ের মাটি ধসে মারা যায় তারা।

দুর্ঘটনার পরপরই সেখান থেকে সরে গেলেও এর রেশ কাটতে না কাটতেই আবারো একইস্থানে বেড়ার ঘর তুলে তিনবছর ধরে বাস করছেন বাচ্চু ও তার প্রথম স্ত্রী রেহানা বেগম।

প্রতি বছর বর্ষা এলেই প্রশাসনের চাপে পরিবার নিয়ে ঘর ছাড়তে বাধ্য হন বাচ্চু মিয়া। কিন্তু দিন শেষে রাতের আঁধারেই তারা আবার ফিরে আসেন সেই জীবন ঝুঁকিতে।

বাচ্চুর আশপাশে একই রকম ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে আরো ২০টি পরিবার, তাদের সবার ঘরেই রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি ঘর তুলে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে প্রতিমাসে তাদের কাছ থেকে নিচ্ছেন ভাড়ার টাকা।

মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে নগরীর তিনস্থানে গিয়ে এ পরিস্থিতি দেখা যায়। ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ও ভূমিধসে মারা যায় ১২৭ জন।   

২০১২ সালের ২৬ জুন রাতে আকবর শাহ এলাকার ইয়াসিন কলোনির কবরস্থানের পাহাড় ধসে ঘর চাপা পড়ে নিহত হয় আটজন। একইদিন নগরীর উত্তর পাহাড়তলীর বিশ্বকলোনি, মক্কীঘোনা ও বাঁশখালীতে তিনজনসহ আরো ১৫ জন নিহত হন।

২০০৮ সালের ১৮ অগাস্ট নগরীর লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে মারা গিয়েছিলেন চার পরিবারের ১১ জন।

প্রতিবছর বর্ষা এলেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে তোড়জোড় শুরু হয় নগরীর পাহাড়গুলো থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরিয়ে নেয়ার। এরপর বৃষ্টি কমলেই ঝুঁকি নিয়ে আবারো একইস্থানে গিয়ে বসবাস শুরু করেন পাহাড়ের বাসিন্দারা।

এবারো বর্ষা মৌসুম শুরু হতেই আগের ১৩টির সঙ্গে নতুন ১৭টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে বলে চিহ্নিত করে প্রশাসন। এসব পাহাড়ে বসতি স্থাপনকারী ছয়শ’ ৬৬টির বেশি পরিবারকে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেয় বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি।

প্রশাসনের হিসেবে চট্টগ্রামের ৩০টি পাহাড়ে অধিক ও কম ঝুঁকিপূর্ণ মিলিয়ে মোট পাঁচ হাজারেরও বেশি পরিবার বাস করছে, যাদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের ও হতদরিদ্র।

টাইগারপাসের বাটালি হিল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ২০১১ সালে হওয়া দুর্ঘটনাস্থলের কোনো চিহ্নই নেই। সেখানে পুনরায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে ২০ থেকে ২২টি ছাপড়া ঘর।  নারী শিশুসহ বাস করছে শতাধিক লোক।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুর্ঘটনার কয়েকমাস পরেই তারা ফিরে ঘর বানিয়ে থাকছেন। বেশি বৃষ্টির সময় প্রশাসনের লোকেরা এসে সরে যেতে বললে কয়েকদিন অন্যত্র গিয়ে থাকেন। পরে আবার ফিরে আসেন।

স্ত্রী-সন্তানসহ পাঁচজনকে হারানো বাচ্চু মিয়া এখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত, রিকশা চালাতে পারেন না, সারাদিনই সেই ঝুপড়ি ঘরে শুয়ে থেকে হাতড়ে বেড়ান পাহাড় ধসে নিহত স্ত্রী-সন্তানদের।

প্রথম স্ত্রী রেহানা বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে যা পান তাই দিয়ে কোনমতে চলে তাদের সংসার।

কেন এখানে ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন-এ প্রশ্নের জবাবে বাচ্চু বলেন, “কই আর যাবো। কিছু করার সামর্থ্য নেই। স্থানীয় লোকজন সাহায্য করে ঘর তুলে দিয়েছে। ভিক্ষার টাকা দিয়েই জীবন চলছে।”

ঘরের ভাড়া দিতে হয় না বলে বাচ্চু মিয়া দাবি করলেও অন্য একটি ঘরের বাসিন্দা মো. মহিউদ্দিন বলেন, ঘর প্রতি মাসে সাতশ টাকা ভাড়া দিতে হয় তাদের।

স্থানীয় এক যুবক প্রতিমাসে ভাড়ার টাকা তুলে নেন বলে জানালেও তার নাম বলেননি তিনি।

২০১১ সালের পাহাড় ধসের প্রত্যক্ষদর্শী মহিউদ্দিন ২০০৭ সালের চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর কথাও জানেন।

তারপরেও এতো কম টাকায় আর কোথাও বাসা ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয় বলেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করছেন বলে জানান এই দিনমজুর।

ওই পাহাড়ের বাসিন্দা রহিমা, হাসানও জানান, মৃত্যুর ঝুঁকি থাকলেও কম ভাড়ার জন্যই এখানে থাকছেন তারা। তাদের অধিকাংশই নোয়াখালী, ভোলা ও কুমিল্লার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসেছেন। কেউ বাসা বাড়িতে কাজ করেন, আর কেউ রিক্সা চালিয়ে অথবা দিনমজুরি খেটে সংসার চালান।

২০১২ সালের ২৬ জুন রাতে প্রবল বৃষ্টিপাতে আকবর শাহ এলাকার ইয়াসিন কলোনি সংলগ্ন পাহাড় ধসে আটজন নিহত হওয়ার স্থানেও গড়ে উঠেছে বসতি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দুর্ঘটনায় যারা স্বজন হারিয়েছেন তারা ঘটনাস্থল ছেড়ে অন্যত্র বাস করলেও নতুন করে গড়ে ওঠা ঘরে বাস করছেন অন্যরা।

বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের শঙ্কা থাকলেও কম ভাড়ার কথা বিবেচনা করে সেখানে বাস করছেন তারা।

দিনমজুর হিসেবে কাজ করা নোয়াখালীর আমিরুননেছা ১৩০০ টাকায় ভাড়া নেন এক কক্ষের একটি বেড়ার ঘর। তিন মেয়েকে নিয়ে থাকেন তিনি।

নোয়াখালী থেকে ১৭ বছর আগে চট্টগ্রামে আসা আমিরুন ওই এলাকায় ধসের সময় সেখানে ছিলেন না।

ওই ঘরে বসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটককমকে তিনি বলেন, “এইখানেই পাহাড় ধসছিল জানি। তারপরও কম টাকায় ভাড়া পেয়েছি, তাই জীবনঝুঁকি নিয়ে বাস করছি।”

পার্শ্ববর্তী ঘরের অপর দিনমজুর ইউসুফ ছয়মাস ধরে থাকছেন ওই এলাকায়।

“বৃষ্টি হলে ভয় লাগে, কখন মাথার ওপর পাহাড় ভাঙ্গে। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী এই এলাকায় ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছে।”

তিনি বলেন, যাদের ঘরের লোকজন মারা গেছে তারা আর এখানে থাকেন না। কোথায় গেছেন তাও জানি না। বেশি বৃষ্টি হলে পুলিশ এসে সরে যেতে বললে সবাই কিছুটা দূরে গিয়ে অবস্থান নেন। বৃষ্টি কমলে আবার সবাই ঘরে ফেরেন।

নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদের পর আবার ফিরে আসা সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল্লাহ বলেন, এদের একপক্ষকে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, আবার অন্যপক্ষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নতুন করে সেখানে বসতি করে থাকছে।

“তাদের বোঝানো হচ্ছে, হাতে ধরে সরিয়ে আনার পরও যাচ্ছে। পাহাড়ে অবৈধভাবে বসতিকারীরা নিম্ন আয়ের। বিভিন্ন এলাকার প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় কম ভাড়ায় তারা থাকছে।”  

নিজরা সচেতন না হলে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান কঠিন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“তাদের সরানোর নানা উপায় নিয়ে আমরা ভাবছি। পাহাড়গুলোর প্রকৃত মালিকদের লিখিত, মৌখিক ও সভা করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদেরও ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে,” বলেন তিনি।

বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ২০০৭ সালের পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর গঠিত বিশেষজ্ঞ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি ৩৮ দফা সুপারিশ দিয়েছিল। এটি বিভাগীয় প্রশাসনের একার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। পাহাড়ে বসতিকারীদের সরিয়ে নিতে সরকারের সব পক্ষের যৌথ উদ্যোগ দরকার।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এস এম আবদুর কাদের বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বসতির জন্য আগের ১৩টিসহ মোট ৩০টি পাহাড় চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব পাহাড়ে বসবাসকারীদের মধ্যে অধিক ঝুঁকিতে থাকার ৬৬৬টি পরিবারকে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা হবে।

পরবর্তীতে ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য পরিবারকে বৃষ্টির সময় সরিয়ে জেলা প্রশাসনের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে। এজন্য একটি সমন্বিত কমিটিও করা হয়েছে।