তথ্য কমিশনকে পিএসসির বুড়ো আঙুল

বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেয়া একজন নাগরিককে তথ্য না দেয়ার অভিযোগ উঠেছে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) বিরুদ্ধে।

রিয়াজুল বাশারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2014, 11:30 AM
Updated : 2 June 2014, 12:58 PM

বিপ্লব কুমার কর্মকার নামের বুয়েটছাত্র ওই নাগরিক তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে তথ্য না পেয়ে অভিযোগ দায়ের করেন তথ্য কমিশনে।

দুই পক্ষের বক্তব্যের ওপর শুনানি শেষে তথ্য কমিশন পিএসপিকে তথ্য দিতে নির্দেশ দিলেও গত ছয় মাসে তা দেয়নি পিএসসি।

দুর্নীতি কমানোর লক্ষ্য রেখে তথ্য অধিকার আইন করা হলেও পিএসপি তথ্য না দেয়ায় আইনের প্রয়োগ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

একজন তথ্য কমিশনার অভিযোগ করেছেন, তথ্য অধিকার আইনের ৭ ধারাকে ‘অপব্যবহার’ করে ‘পাবলিক ডকুমেন্ট’ সরবরাহ করছে না পিএসসি।

তথ্য চেয়ে আবেদন করা বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিপ্লব কুমার কর্মকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নাগরিক হিসাবে তথ্য পাওয়ার অধিকার আমার আছে। কিন্তু পিএসসি ও তথ্য কমিশন কেউই আমার সেই অধিকার রক্ষা করতে পারছে না।”

২৯তম বিসিএস লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও কোনো ক্যাডারের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হননি বিপ্লব কুমার। এরপর ২০১৩ সালের ৫ মে পিএসসিতে তিনটি তথ্য চেয়ে আবেদন করেন তিনি।

তথ্য তিনটি হলো- ১. ২৯ তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছিলেন বিপ্লব? ২. ওই বিসিএসে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, কাস্টমস, পুলিশ ও ট্যাক্স ক্যাডারে সুপারিশকরা মেধাতালিকায় সর্বশেষ নম্বরপ্রাপ্ত প্রার্থীর (লিখিত ও মৌখিক) কত? ৩. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উত্তরপত্র যে পরীক্ষক মূল্যায়ন করেছিলেন তার কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি আছে কি না এবং থাকলে তার সংক্ষিপ্ত পরিচিত।

ডাকযোগে এই তিনটি তথ্য চাওয়ার পর পিএসসি কোনো উত্তর না দেয়ায় বিপ্লব কুমার তথ্য কমিশনের দ্বারস্থ হন।

প্রথমে আপিল করে কোনো সাড়া না পেয়ে গত বছরের অগাস্টে তথ্য কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ আমলে নিয়ে কমিশন শুনানির জন্য বাদী ও বিবাদীকে সমন জারি করে।

কমিশনের শুনানিতে তথ্য না দেয়ার বিষয়ে পিএসপির প্রতিনিধি যে যুক্তি তুলে ধরেন, তা তথ্য কমিশনের সিদ্ধান্তপত্রে বর্ণনা করা হয়েছে।

“বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ও দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই) তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, অভিযোগকারীকে ইতোমধ্যে তার প্রার্থীত তথ্যের মধ্যে লিখিত পরীক্ষার নম্বর সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু ১ ও ২ নং ক্রমিকের যাচিত মৌখিক পরীক্ষার নম্বর প্রদানের কোনো বিধান বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ের না থাকায় তা সরবরাহ করা হয়নি।”

পিএসসি প্রতিনিধি শুনানিতে বলেন, “মৌখিক পরীক্ষার নম্বর সরবরাহ করা হলে সরকারি কর্মকমিশনের সাংবিধানিক নিরপেক্ষতা, গোপনীয়তা, দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, বোর্ডের দায়িত্ব পালনকারী সাংবিধানিক পদধারীগণের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্ষুন্ন হবে। ৩ নং ক্রমিকে উল্লেখিত তথ্য প্রদান করা হলে পরীক্ষকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হবে।”

তবে শুনানিতে পিএসসি প্রতিনিধির বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তথ্য কমিশন। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বক্তব্য শুনে গত বছরের ১৭ নভেম্বর তথ্য কমিশন আবেদনকারীর চাওয়া তিনটি তথ্যের বিষয়েই সিদ্ধান্ত দেন।

‘পাবলিক ডকুমেন্ট’ হওয়ায় বিপ্লব মৌখিক পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছেন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উত্তরপত্র মূল্যায়নকারী শিক্ষকের নাম উল্লেখ না করে তার শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য আবেদনকারীকে জানানোর জন্য পিএসসিকে নির্দেশ দেয় তথ্য কমিশন। এ দুটি তথ্য ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বরের মধ্যে দিতে বলা হয়।

আর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় সুপারিশ করা মেধাতালিকায় সর্বশেষ নম্বর জানতে ‘পরীক্ষার্থীগনের রেজিস্ট্রেশন নম্বর’ উল্লেখ করে বিপ্লবকে পিএসসিতে পুনরায় আবেদন করার নির্দেশ দেয় তথ্য কমিশন।

মেধাতালিকার সর্বশেষ নম্বর জানতে গত ফ্রেব্রুয়ারিতে বিপ্লব পুনরায় আবেদন করেন। কিন্তু কমিশন আদেশ দেয়ার পরও কোনো তথ্যই সরবরাহ করেনি পিএসসি।

এরপর গত ৩০ এপ্রিল তথ্য কমিশনের শুনানিতে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর আবেদনকারীকে দেওয়ার জন্য লিখিত অঙ্গীকার করেছেন পিএসসি প্রতিনিধি।

নির্দেশ দেয়ার পরও পিএসসি কেন তথ্য দিচ্ছে না জানতে চাওয়া হলে প্রধান তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাদের কোনো রিজার্ভেশন থাকতে পারে অথবা এই আইনটা তাদের বুঝতে সময় লাগতে পারে বা তারা বুঝছে না।”

কিন্তু কমিশন নির্দেশ দেয়ার পরও কেন তথ্য দেয়া হচ্ছে না- পিএসসি থেকে তা জানানোও হয়নি বলে অভিযোগ প্রধান তথ্য কমিশনারের। আগামী সপ্তাহের শুনানিতে পরবর্তী সিদ্ধানের জন্য এ বিষয়টি উঠতে পারে বলেও জানালেন তিনি।

পিএসসি কেন তথ্য দিচ্ছে না সে বিষয়ে জানতে চাওয়ার জন্য পিএসসির চেয়ারম্যান একরাম আহমেদকে টেলিফোনে পাওয়া যায়নি। গত কয়েকমাস ধরে পিএসসির জনসংযোগ কর্মকর্তার পদও ফাঁকা রয়েছে।

অভিযোগকারী বিপ্লব কুমার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কমিশনের শুনানিতে জেরার জবাবে পিএসসির তথ্য কর্মকর্তা মীর মোশাররফ হোসেন বলেন, পিএসসিতে পূর্ণাঙ্গ মেধা তালিকা তৈরি হয় না।”

“একথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি তথ্য কমিশনকে আবেদন করে জানতে চেয়েছি, মেধাতালিকা না হলে পিএসসি কিসের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয় এবং বাদ দেয়। তবে এ বিষয়টি নিয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি।”

তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তথ্য অধিকার আইনটি হয়েছে যাতে যে কোনো নাগরিক যে কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চাইতে পারে এবং সেই কর্তৃপক্ষ তথ্য দিতে বাধ্য।”

তথ্য অধিকার আইনের ৭ ধারায় ২০টি বিষয় উল্লেখ বলা হয়েছে, এ বিষয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তথ্য দিতে বাধ্য নয়।

এ ধারার উল্লেখ করে সাদেকা হালিম বলেন, “এখানে কোথাও বলা নেই যে, মৌখিক পরীক্ষার ফল দিতে পারবে না। মৌখিক পরীক্ষার ফল জানার অধিকার আছে এবং এটা ধারা ৭ এর মধ্যে পড়ে না। পরীক্ষার ফল যদি পাবলিক ডকুমেন্ট হয় তাহলে মৌখিক পরীক্ষার ফল পাবে না কেন?

“তারা ধারা ৭ এর অপব্যবহার করছে এবং এটা করা ঠিক হচ্ছে না।”

মৌখিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ না করার ক্ষেত্রে অনিয়ম বেরিয়ে পড়ার সন্দেহ প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম।

“এই ভাইবাতেই সবেচেয়ে বেশি দুর্নীতি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের। এখানেই স্বজনপ্রীতি, এখানেই রাজনৈতিক প্রভাব, এই ভাইবা বোর্ডে বসে।”

“সরকার তথ্য কমিশন করেছে, তাহলে আরেকটা সাংবিধানিক সংস্থা কেন তার আদেশ মানছে না।”

তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে তথ্য কমিশনের নির্দেশ অমান্য করলে কমিশন জরিমানা করতে পারে এবং তথ্য সংগ্রহ করে দিতে পারে।

এক্ষেত্রে কমিশন কি করবে জানতে চাওয়া হলে প্রধান তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ ফারুক বলেন, “ওরা যদি তথ্য দিতে অপারগ হয় তারা গ্রাউন্ড দিয়ে জানিয়ে দেবে। সেটা জানাচ্ছে না। এই কেসটা আবার উঠবে। এটা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না।”

এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা তথ্য কমিশনের বিষয়, দেখি আমরা তথ্য কমিশন কী করতে পারে। তথ্য কমিশন না পারলে আবেদনকারী আদালতে যেতে পারে। এটা তো আইনের বিষয়।

“তথ্য কমিশন আদেশ দিয়েছে, সেই আদেশ না মানা হলে তথ্য কমিশন ব্যবস্থা নেয় কি না আমরা দেখি।”