জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নই উঠে না: আইনমন্ত্রী

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর বিচার নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষাপটে মন্ত্রী বলেছেন, ‘ভুল’ বোঝাবুঝি হয়েছে। আইন সংশোধন করার পর বিচার শুরু হবে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 May 2014, 05:13 PM
Updated : 1 June 2015, 03:48 PM

মন্ত্রী আনিসুল হক শনিবার একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার হবেই। এ নিয়ে সমঝোতার কোনো প্রশ্নই আসে না। বরং কোনো দিন যাতে কেউ প্রশ্ন করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা নেয়া হচ্ছে।”

একাত্তর টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী তার দুদিন আগে দেয়া বক্তব্যের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন, যে কথা নিয়ে তার সমালোচনা উঠেছে।  

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বর্তমান আইনে কোনো সংগঠনের সাজা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নেই মন্তব্য করে আইনবিদ আনিসুল হক বলেন, আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

কবে নাগাদ এটি সংসদে উত্থাপন করা হবে-জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “এটাই মূল প্রশ্ন। এ কথাটাই আমি বলতে চেয়েছিলাম-আইনে সংশোধনী আনার বিষয়ে আমার মন্ত্রণালয়কে ইতোমধ্যে [বৃহস্পতিবার] ইন্সট্রাকশন দিয়েছি।এখানে যে পরিবর্তনটা দরকার সে পরিবর্তনটা বিচার কাজ শুরু হওয়ার আগেই করা দরকার।”

৫ মাস তদন্ত শেষে যখন মামলা দায়েরের অপেক্ষায় তখন এমন সংশোধনীর কথা কেন?

ব্যাখ্যা দিয়ে মন্ত্রী বলেন, “মনে রাখতে হবে, ছয় মাস পরে বিচার কাজটা যখন শেষের পথে আসবে, বিচারক যখন বলেন আমি তোমাকে কী সাজা দেব…আমি কী জামায়ারতে সেন্টেন্স অব ডেথ দিতে পারব?"

“তদন্তের সঙ্গে কোর্টের সম্পর্ক নেই। তদন্ত যেটা হয়েছে সঠিক হয়েছে, মামলা বিচারে যাওয়ার আগে এই প্রভিশনটা না বদলায় তাহলে ছয় মাস পরে গিয়ে প্রশ্ন আসবে।”

আগামীতে যাতে ভুলত্রুটির সুযোগ না থাকে তা মাথায় নিয়ে মন্ত্রণালয় এগোচ্ছে বলে জানান আনিসুল হক।

“আমি জামায়াতকে শাস্তি দেয়ার জন্যে মামলাটা রুজু করছি। জামায়াতকে শাস্তি দিতে চাই।…আজকে দুঃখের সঙ্গে বলছি-বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এটা মনে রেখে করেছিলাম- একশ’ বছর পরে হলেও এ মামলার রিসার্চ হবে। একশ’ বছর পরেও যেন রিসার্চের সময় কেউ ভুলত্রুটি খুঁজে না পায়। সে চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা করা হয়েছিল। জেল হত্যা মামলা, বিডিআর হত্যা মামলা হয়েছিল…সব বিবেচনা করে।”

ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে শনিবার আইনজীবীদের এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও ছিলেন।

আইনমন্ত্রী বলেন, “সংগঠনকে কী রকম সাজা দেওয়া যাবে, কী রকম সাজা হবে তা এখানে পরিষ্কার কিছু নেই। আমি শুধু সেটাকে পরিষ্কার করার জন্যে বলেছি...এটা নিয়ে যেনো কোনো কনফিউশন না হয়। তা পরিষ্কার করে আদালতে যেতে হবে। সে চেঞ্জটা আদালতে যাওয়ার আগে করতে হবে।

“১৯৭৩ সালে যখন আইনটা হয়েছিল তখন তা গ্রপ অব ইনডিভিজুয়াল ছিল। কিন্তু আদালতে যখন বলেছে দল অপরাধ করেছে, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। তখন তদন্ত শুরু হয়েছে। তখন সংশোধনী এনে অর্গানাইজেশনটা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

“আমি কারো ভুল ধরার চেষ্টা করছি না। তারপরে যেটা করা উচিত ছিল- অর্গানাইজেশন হলে তাকে কী শাস্তি দেয়া হবে সে জিনিসটা পরিষ্কার করা।”

সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতা হয়েছে, মন্ত্রীর বক্তব্য এমন গুজবকে ভিত্তি দিয়েছে- প্রশ্নকর্তার এমন ব্যাখ্যার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, “আমার বোধ হয় যে ভুলটি হয়েছে, আমি একটা জিনিস ধরে নিয়েছি, ধরে নেয়া হয়ত ঠিক হয়নি।

“ভাবছিলাম, আই উইল বি ট্রাস্টেড, সকলে জানেন মনে করে গ্রান্টেড ধরে নেয়াটা ঠিক হয় নি। আমার বিশ্বাস যে আমার ওপর আস্থা আছে, এখানে আমার কোনো কমিটমেন্টের ঘাটতি নেই। সেটা থেকে যে একথাগুলো বলছি- যেটা হয় না। একটা কথা পরিস্কারভাবে বলছি-আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াত এবং জামায়াতের সাথে যারা তখনকার নিয়ন্ত্রক সকলে যুদ্ধাপরাধের জন্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচার করবে, বিচার করতে বদ্ধপরিকর। এর মধ্যে সমঝোতার কোনো প্রশ্নই আসে না।”

“এ বিচারের ব্যাপারে আমি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলি না। এ বিচার রাজনীতির উর্ধ্বে আমার কাছে। আমাকে তো ভুল বোঝা হয়েছে। আমি যে অবস্থান থেকে কথা বলেছি সেটা হচ্ছে-আমার প্রতি একটা আস্থা আছে। আমি যে এটা নিয়ে রাজনীতি করব না এটা সম্বন্ধে সকলে বোধ হয় জানেন। আমাকে কিছু না হলেও আমার পরিচিতি উনারা জানেন সেটা হয়ত আমার ভুল হয়েছে। এ টুকু স্বীকার করেছি। কিন্তু আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই- এখানে কোনো সমঝোতার প্রশ্ন নাই। এখানে কোনো রাজনীতির প্রশ্ন নাই।”

জামায়াতের বিচার নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে [প্রথম আলো] প্রকাশিত সংবাদের তার বক্তব্য সঠিকভাবে আসেনি বলেও দাবি করেন আনিসুল হক।

“আমার কথাগুলোকে এমনভাবে লেখা হয়েছে-এজ ইফ, আই এম এগেইনস্ট দিজ ট্রায়াল। আমি কোন প্রশ্নটার জবাবে কথাগুলো বলছি-…‘এখন এটার সময় নয়’- এটা আমি একথায় বলি নি। আমি যেটা বলেছিলাম-ঠিক এর আগে আমাকে যে প্রশ্নটা করা হয়েছিল- প্রসিকিউশন টিমের মধ্যেও গণ্ডগোল আছে। আপনি গন্ডগোলগুলো নিরসন করবেন কিনা? আমার জবাবটা পুরোটা আসে নাই। যেটা আমি বলেছিলাম- দেখেন, সেটা নিয়ে আলাপের ব্যাপার এখন না। সেটা নিয়ে এখনও এটার সময় না। ওটা আমি ঠিক করে নেব। এটা মিন করেছি। উনারা ঠিক ওই জায়গাটার সাথে একথাটা লিঙ্ক করে আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।  এটা তো ঠিক না।”

মন্ত্রীর বক্তব্য বিচার কাজে বা জণগনকে প্রভাবিত বা বিভ্রান্ত করবে কিনা- জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, “আমি শুধু একটা কথা বলতে চাই-আমি এখানে যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে চাই। এটা হচ্ছে আমার থিউরি। কেউ কোনো দিন যেন এটা নিয়ে, জামায়াতের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। সেজন্যে যে সাবধানতা অবলম্বনের দরকার তা আমি করবো। এটাই মূল বক্তব্য আমার।”

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে বিভক্তির কথাও আসে সাক্ষাৎকারে।

প্রসিকিউশনের ভেতরে রেষারেষি হলে বিচারটা করবেন কখন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এই যে প্রসিকিউশন টিমের মধ্যে যে রেষারেষিটা চলছে এটা নিয়ে আমি পাবলিকের কাছে যাব? আমি তো চাচ্ছিলাম-এটা ঘরের মধ্যে, তাদের ঠিক করতে। আমি তাদের সঙ্গে বসেছি। তাদের সঙ্গে বসে আমি বলেছি, প্রত্যেকের সঙ্গে বসেছি, বলেছি-আপনারা যে দায়িত্বপালন করছেন তার মর্ম কি বুঝেন? আপনারা যে নিজেরা নিজেরা মারামারি করছেন তাতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “এ কথাগুলো বলার প্রয়োজন ছিল, কারণ হচ্ছে যে-এই যে আপনারা বলছেন, তদন্ত রিপোর্ট পড়ে আছে কিন্তু বিচার শুরু হচ্ছে না, জামায়াতের সাথে আন্ডারস্টেন্ডিং হচ্ছে-এসব কথা আমি রাজনৈতিক অঙ্গনে হচ্ছে এসব শুনেছি।”

এ বিচার নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ না রাখার আহ্বান জানান তিনি।

“আমি যে জিনিসগুলো পরিষ্কার করার, তা পরিষ্কার করেছি এ আত্মবিশ্বাসে- সমঝোতার কোনো প্রশ্নই উঠে না।”

শেখ হাসিনার ২০০৯ সালে ক্ষমতা নেয়ার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। এরপর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মুজাহিদসহ কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড হয়; কারাদণ্ড হয় গোলাম আযমের।  

যুদ্ধাপরাধের বিভিন্ন রায়ে জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল’ এবং একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে দলটির ভূমিকা উঠে আসার পর জামায়াতের বিষয়ে তদন্তও শুরু করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল।

আনিসুল হকও শনিবার ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে এক সভায় তার আগের অবস্থান ধরে রেখে বলেন, জামায়াতের বিচার করতে হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন করতে হবে।

বর্তমান আইন সংশোধন না করে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিচার সম্ভব নয়।

জাপান সফর নিয়ে শনিবার গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, “আমাদের মন্ত্রী তো ঠিকই বলেছেন। আইনগতভাবে যেটা বাস্তব, সেটা বলেছেন।”

নতুন সরকারের আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পান এবারই প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দায়িত্ব সামলে এসেছেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির পাশাপাশি দল বা সংগঠনের বিচারের সুযোগ রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধনের বিল পাস করেছে জাতীয় সংসদ।

১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনে সরকারের আপিলের কোনো সুযোগ ছিল না।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ বিচারে ব্যক্তিগত এবং দলবদ্ধ অপরাধের বিচারের ধারা সংযুক্ত করে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট সংশোধন করা হয় প্রথমবার ২০০৯ সালের ৯ জুলাই। এরপর ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আসামির পাশাপাশি সরকারেরও আপিলের সমান সুযোগ রেখে সংশোধনী আনা  হয়।

বর্তমান আইনে জামায়াতের বিচারের সুযোগ নেই বলে কথিত বক্তব্যের পর নানা মহলে মন্ত্রীর সমালোচনা উঠে, দাবি ওঠে মন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারেরও।