র‌্যাবকে দায়ী করলেন নজরুলের শ্বশুর

কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে অপহরণ করে হত্যার জন্য সরাসরি র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন তার শ্বশুর শহীদুল ইসলাম।

মুজিবুল হক পলাশবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 May 2014, 03:42 PM
Updated : 4 May 2014, 07:41 PM

রোববার চাষাঢ়া রাইফেলস ক্লাবে আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমানের উপস্থিতিতে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কাউন্সিলর নূর হোসেন অর্থ দিয়ে র‌্যাবের মাধ্যমে তার জামাতাকে হত্যা করিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সমর্থক নজরুলকে হত্যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখতে শামীম ওসমানও সরকারকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।

গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের লাশ পাওয়া যায়।   

নজরুল পরিবার প্রথমেই ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেনের দিকে অভিযোগ তুলেছিলেন। মামলায় প্রধান আসামিও করেছিলেন তাকে।

এরমধ্যে পালিয়ে যাওয়া নূর হোসেনের কার্যালয় ক্ষুব্ধ জনতা পুড়িয়ে দেয়ার পর শনিবার তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একটি গাড়ি জব্দ এবং ১২ জনকে আটক করে পুলিশ।

নূর হোসেনের বাড়িতে পুলিশি অভিযান

তার একদিন বাদেই নূর হোসেন র‌্যাবকে দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে দাবি করলেন নজরুলের শ্বশুর। এর সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. ইয়াসিনও জড়িত বলে দাবি করেন তিনি।

শহীদুল বলেন, “নূর হোসেন ও ইয়াসিন মিয়াসহ এজাহারভুক্ত আসামিদের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা নিয়ে র‌্যাব নজরুলসহ সাত জনকে খুন করেছে।”

তিনি বলেন, ২৭ এপ্রিল দুপুরে যখন নজরুলসহ সাতজনকে দুটি গাড়িতে তুলে নেয়া হয়, সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বালু শ্রমিকরা তাদের জানিয়েছে, র‌্যাব-১১ লেখা একটি গাড়ি সেখানে ছিল।

ঘটনাটি শামীম ওসমানকে জানানো হলে তার পরামর্শে সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজীতে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়কের সঙ্গে দেখা করেছিলেন বলে জানান শহীদুল।

“সিও (কমান্ডিং অফিসার) আমাকে ৬ ঘণ্টা আটকে রেখে নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।”

এরপর র‌্যাব-১১ এর তৎকালীন অধিনায়কসহ জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে ফতুল্লা থানায় গিয়েছিলেন জানিয়ে শহীদুল বলেন, “কিন্তু এসপি, ওসি তাদের বিরুদ্ধে মামলা নেননি। তারা বলে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না।”

এই ঘটনার পর থেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলেও জানান নিহত নজরুলের শ্বশুর।

নজরুলের অপহণের পর যে দিন বিকালে নজরুলের লাশ ভেসে ওঠেছিল, সেদিন সকালেই র‌্যাব-১১ অধিনায়ককে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে আনা হয়। এই সেনা কর্মকর্তাকে  তার বাহিনীতেও ফেরত পাঠানো হয়েছে।

নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের বিষয়ে শামীম ওসমান এর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিচের লেভেলের অসাধু কোনো কর্মকর্তা জড়িত কি না, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।”

“র‌্যাব নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এমনও তো হতে পারে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু কোনো কর্মকর্তা বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এই কাজটি করে থাকতে পারেন। এতে করে তারা নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হল এবং সরকারকেও বিব্রত অবস্থায় ফেলা হল।”

নজরুল অপহরণের পর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে র‌্যাবের অতিরিক্ত পরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানকেও বিষয়টি জানিয়েছিলেন বলে জানান স্থানীয় এই সংসদ সদস্য।

এই অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে শামীম ওসমানের নাম জড়িয়েও বিভিন্ন সংবাদপত্রে অভিযোগ এসেছে, যদিও তা ‘মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।

এর মধ্যেই রোববার সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলের একটি কারখানা থেকে সন্দেহজনক একটি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে, যে কারখানার মালিক শামীম ওসমানের মামাশ্বশুর। গাড়িটি নূর হোসেনের ভাই জজ মিয়ার বলে কারখানার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

রোববার জব্দ করা সন্দেহজনক গাড়ি

এই বিষয়টি তদন্তকারীদের গুরুত্বে সঙ্গে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী।  নারায়ণগঞ্জে অব্যাহত সন্ত্রাসের জন্য শামীম ওসমানের পরিবারের দিকেই তার অভিযোগের আঙুল।

আইনজীবী চন্দনসহ সাতজনকে হত্যার প্রতিবাদে রোববার জেলা আইনজীবী সমিতির ডাকে নারায়ণগঞ্জে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। মেয়র আইভীসহ কাউন্সিলর ও সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রোববার থেকে ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতিও শুরু করেছেন।

এদিকে রাইফেলস ক্লাব থেকে বিকালে সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে জনসভায় যান শামীম ওসমান। নজরুল হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ওই জনসভায় তার শ্বশুর শহীদুলও সংসদ সদস্যের সঙ্গে যান।

নূর হোসেন আওয়ামী লীগ করলেও তার ‘লোক’ নয় বলে দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের জেলা নেতা শামীম ওসমান।

তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন, আইভীর সমর্থক আবু সুফিয়ানের সঙ্গে নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এই বক্তব্যের পক্ষে একটি অডিও রেকর্ডও সমাবেশে প্রকাশ করেন তিনি।

নূর হোসেনের ১১ অস্ত্র

আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন ও তার সহযোগীরা গত দুই বছরের ১১টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন জানিয়ে তার একটি তালিকা সাংবাদিকদের দিয়েছেন নজরুলের শ্বশুর শহীদুল।

তার তালিকা অনুযায়ী, এই অস্ত্রের মধ্যে সাতটি শটগান, দুটি পিস্তল, একটি রাইফেল ও একটি রিভলবার রয়েছে। ২০১২ সালে রাইফেল ও একটি শটগানের লাইসেন্স দেয়া হয়। বাকি সব অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয় ২০১৩ সালে।

নূর হোসেনের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ

নিয়ম অনুযায়ী, শটগানের লাইসেন্স দেন জেলা প্রশাসক। পিস্তল ও রিভলবারের লাইসেন্স জেলা প্রশাসকের সুপারিশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেয়।

সবগুলো অস্ত্রের লাইসেন্স নারায়ণগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক মনোজ কান্তি বড়ালের হাত দিয়ে হয়েছে। নজরুল অপহরণের পর তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে আনা হয়।

নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও শ্বশুর শহীদুলের দাবি, এসব অস্ত্রের মালিকদের গ্রেপ্তার করলেই হত্যার রহস্য উন্মোচিত হবে।

নূর হোসেন ছাড়াও এই অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের মধ্যে রয়েছে তার ভাই নূরউদ্দিন মিয়া, তার ভাতিজা ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহজালাল বাদল, তার সহযোগী  মো. শাহজাহান, আলী মোহাম্মদ, সানাউল্লাহ ও জামালউদ্দিন।

আন্তঃজেলা ট্রাক চালক ইউনিয়নের সিদ্ধিরগঞ্জ শাখার সভাপতি নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সিদ্ধিরগঞ্জ কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি মো. আরিফুল হক হাসানের নামেও দুটি অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে।

নজরুলের পরিবার এসব লাইসেন্স বাতিলের দাবি তোলার প্রেক্ষাপটে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি আবদুল মতিন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা অস্ত্রগুলোর লাইসেন্স বাতিলের প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। প্রতিবেদন পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের কার্যালয় হয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যাবে।”