রানা প্লাজা: ভাবনায় সন্তানের ভবিষ্যৎ

রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ার পর কোনোমতে প্রাণে বেঁচে আসলেও ভয়াবহ এই ঘটনা পাল্টে দিয়েছে অনেকের জীবন, ভাবনার জগত।

গোলাম মুজতবা ধ্রুব ফয়জুল সিদ্দিকীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2014, 03:54 PM
Updated : 23 April 2014, 11:36 PM

সম্প্রতি এ রকম দুই নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। তারা শোনান, নিজের জীবনে ক্ষতির পাশাপাশি দুর্ঘটনায় গর্ভের সন্তানকে নিয়ে বোনা স্বপ্নভঙ্গের কথা।

ঘটনার সময় দুজনই ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর সঙ্গে মিলে অনাগত সন্তানকে ঘিরে অনেক স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন তারা।

কিন্তু একই ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুতে একজন হয়ে পড়েন দিশেহারা; আর অসুস্থতাকে সঙ্গী করে সন্তানের পৃথিবীতে আসায় বদলে গেছে অন্যজনের জগত-সংসার।

তবে দুজনের মিল একই জায়গায়- আর কোনো দিন পোশাক কারখানায় কাজ করবেন না তারা।

রানা প্লাজা ধসের এক বছর পূর্ণ হতে চলার সময় ধ্বংসস্তূপ থেকে ফেরা লিলি আক্তার ও শেফালী বেগম এভাবেই জানিয়েছেন তাদের কথা।

“কোনো দিনও গার্মেন্টসে কাজ করবো না। ছোট থাকতে স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই এতিম হইছি। ভাবছিলাম সন্তান হইলে ওর সব স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ করুম।

“কিন্তু ভাগ্য কি কারো ইচ্ছা মাইনা চলে?” প্রশ্ন করে কেঁদে ফেলেন মাগুরার মেয়ে লিলি আক্তার।

গত বছরের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ার সময় ওই ভবনের অষ্টম তলার একটি পোশাক কারখানার সুইং বিভাগে কাজ করতেন তিন মাসের অন্তঃসত্বা লিলি।

ভবন ধসে পড়ার প্রথম দিনই ধ্বংস্তূপের নিচ থেকে কোনমতে বেরিয়ে আসেন তিনি। কিন্তু একই দিনে উদ্ধারকর্মীরা বের করে তার স্বামী জুয়েল শেখের লাশ।

ছোট্ট শিশু জুনায়েদকে কোলে নিয়ে অশ্রুসিক্ত গলায় লিলি বলেন, “ছেলে জন্ম নেয়ার পর বাবাকে দেখতেই পেল না। ওর স্বাদ-আহ্লাদ নিয়ে ভাবারও কেউ নাই।”

ছেলেকে নিয়ে সাভারেই একটি বস্তিতে ঘর ভাড়া করে আছেন জানিয়ে লিলি আক্তার বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার দিনই অধরচন্দ্র মাঠে তার লাশ সনাক্ত করে ২০ হাজার টাকা পান।

এছাড়া বিজিএমইএ থেকে দেয়া নিজের বেতনের ১৬ হাজার এবং পরে বি-ক্যাশের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন তিনি।

বিলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানও তার পাশে দাঁড়িয়েছে। ছেলে হওয়ার সময় তাকে প্রতিমাসে কিছু খাবার দিত তারা। তখন থেকেই হাত খরচ বাবদ তিন হাজার টাকা করে দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।

“এভাবে কোনো রকমের বেঁচে আছি। কিন্তু ছেলেটার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে সব অন্ধকার লাগে,” বলেন লিলি।

আপনি কি আবার কোনো কারখানায় কাজ করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখনো সেই দিনের কথা ভুলতে পারি না। সকালে গার্মেন্টসে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই একটা বিকট শব্দে ভেঙে পড়ে ভবনটি। সব কিছু অন্ধকার হয়ে যায়। জীবন বাঁচাতে কে কোথায় ছুটে গেছিলাম কারোরই হুঁশ ছিল না।

“পরে বের হয়ে জানলাম, আমার স্বামীসহ অনেকেই বাঁইচা নাই। ওই ভয়- আমি কোনদিন ভুলতে পারি না।

“আর কোনো দিন আমি গার্মেন্টসে কাজ করবো না, অনেক ভয় লাগে।”

সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন নয় তলা রানা প্লাজায় পাঁচটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন কয়েক হাজার শ্রমিক।

এ ঘটনায় এক হাজার একশ’ ৩৫ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশই পোশাক কর্মী। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে দুই হাজার ৪৩৮জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়, যাদের মধ্যে গুরুতর আহত ৮৫০ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

ওই ভবনের ষষ্ঠ তলায় ইথারটেক্স নামের কারখানায় কাজ করতেন শেফালী বেগম, যিনিও আর কখনো পোশাক কারখানায় কাজ করতে চান না।

“আর কোন দিন ভাই গার্মেন্টসে কাজ করবো না। খুব ভয় লাগে- যদি আবারো গার্মেন্টস ভেঙে পড়ে।”

সন্তান কোলে শেফালী বেগম

শেফালী বলেন, রানা প্লাজার চার তলায় তার আপন দুই বোন রাজিয়া বেগম ও লিপি আক্তার কাজ করতেন। ঘটনার সাত দিনের মাথায় ছোট বোন লিপির এবং অন্য দিনের মাথায় রাজিয়ার লাশ উদ্ধার হয়।

“এখনো চোখের সামনে সেই দিনের ঘটনাগুলো ভেসে আসে। তখন নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। সকালে সেদিন কাজ শুরু করার এক ঘণ্টার মধ্যেই বিকট শব্দ হয়। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার চেচামেচি করতে থাকে সবাই।”

“তিন মাসের অন্তঃস্বত্তা থাকার পরেও সন্ধ্যার দিকে তিন তলার একটি পিলার সরিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়ি। তারপর অনেকক্ষণ জ্ঞান ছিল না।”

তখন মাথার এক জায়গায় আঘাত ছাড়াও বাঁ পায়ের বাটি খুলে যায় বলে জানান শেফালী।

তখন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাকে।

“এরপর সন্তান হলে জানলাম- ওর মাথায় পানি জমেছে। অপারেশন করতে হবে। তারপরেও ও কোনদিন সুস্থ হবে না।”

সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন এই মা বলেন, “জন্মের পর থেকেই ও অসুস্থ। হয়তো এ দুর্ঘটনাই ওর অসুস্থতার কারণ।”

শেফালী জানান, তার স্বামী দেলোয়ার হোসেন রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। তার রোজগারেই সাভারের একটি বস্তিতে বাসা ভাড়া নিয়ে চলছে তাদের সংসার।

ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই দফায় বি-ক্যাশে ৩০ হাজার টাকা এবং বিজিএমইএ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পেয়েছেন।