‘ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের নজির রানা প্লাজা’

রানা প্লাজার ঘটনাকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার নজির বলে অভিহিত করে এরকম দুর্ঘটনা ঠেকাতে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করতে তাগাদা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2014, 12:07 PM
Updated : 23 April 2014, 04:04 PM

বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ একজন মুখপাত্র বলেন, “কাজের সন্ধানে আসা মানুষকে যেন লাশ হয়ে হয়ে ফিরে যেতে না হয়। কর্ম পরিবেশ উন্নত করার মাধ্যমে রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে তা নিশ্চিত করি আমরা।”

ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা নামের নয় তলা একটি ভবন ধসের বর্ষ পূরণ হওয়ার আগের দিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল।

গত বছরের ২৪ এপ্রিল এই ভবন ধসের ঘটনায় ১১৩৫ জন নিহত হয়, যাদের প্রায় সবাই ওই ভবনে অবস্থিত ৫টি পোশাক কারখানার শ্রমিক।

ভবন ধসের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের নিহত হওয়ার এ ঘটনা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতেও বেশ আলোচনা হয়।

দলমত নির্বিশেষে সবাইকে গার্মেন্টস শিল্পের উন্নয়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে শাকিল ঘটনার পর পোশাক শিল্পের জন্য সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং আহত ও নিহতদের জন্য বিভিন্ন অর্থ সহায়তার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন।

 

বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি পোশাক শ্রমিক ও অভিবাসী শ্রমিকদের কারণেই শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে মন্তব্য করে শাকিল বলেন, “রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর জাতি হিসেবে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার একটি উদাহরণও হয়ে থাকবে রানা প্লাজা।”

ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্ধার কাজ সার্বক্ষণিক তদারকি করেন জানিয়ে তার বিশেষ সহকারী শাকিল বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাল বিলম্ব না করে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য ও শক্তি প্রয়োগ করে উদ্ধার কাজে অংশ নিতে নির্দেশ দেন।”

সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, “দুর্ঘটনার পর বেলা ১১টার সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করে জানতে চান, কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটলো। এরপর বেলা তিনটের সময় আবার ফোন করেন। এভাবেই তখন সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী এবং বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।”

দুর্ঘটনার পর উদ্ধার অভিযানে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নামানো হয় নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, আনসারসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে।

বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও স্বেচ্ছ্বাসেবীরাও উদ্ধারে অংশ নেন।

২১ দিন উদ্ধার অভিযান চালানোর পর আনুষ্ঠানকিভাবে তা বন্ধ করা হয়।

এ প্রসঙ্গে মাহবুবুল হক শাকিল বলেন, “এ ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এতো দীর্ঘ সময় উদ্ধার অভিযান চালানোর নজির তেমন একটা নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, একজন মানুষও ভেতরে থাকা অবস্থায় উদ্ধার অভিযান বন্ধ করা যাবে না।”

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রানা প্লাজার ধংসস্তুপ থেকে ২,৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। মরদেহ উদ্ধার করা হয় ১১১৭টি। হাসপাতালে মারা যান ১৮ জন। ৮৮৪টি মরদেহ সনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং বাকী ২৯১টি মরদেহের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ভবন ধসের পর রানা প্লাজা ও পোশাক কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করে তাদেরকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

সাভার পৌরসভার একাধিক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়।

 

প্রধানমন্ত্রীর অনুদান

প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের পরিবারের জন্য সহায়তা করে যাওয়া হচ্ছে।

এর মধ্যে রয়েছে, ৩৬ জন গুরুতর আহতের জন্য তিন কোটি ৯০ লাখ টাকা পারিবারিক সঞ্চয়পত্র, ৭৯৮ জন নিহতের পরিবারের জন ১২ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার ১০৪৭টি চেক প্রদান, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে সনাক্ত করা ১৬৪ নিহতের পরিবারের জন্য ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকার চেক প্রদান।

শাকিল জানান, উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া স্বেচ্ছ্বাসেবক এজাজউদ্দিন চৌধুরী কায়কোবাদ আঘাতপ্রাপ্ত হলে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়, যাতে ব্যয় হয় এক কোটি ৫ লাখ টাকা।

কায়কোবাদ মারা গেলে তার পরিবারকে ১২ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে।

হাসপাতালে ভর্তি ৭৫০ জন আহতের চিকিৎসার জন্য ৭৫ লাখ টাকা অনুদান, আহতদের চিকিৎসার জন্য ২২টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এক কোটি ৪২ লাখ টাকা অনুদান। নিহতদের পরিচয় নির্ধারনে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ৫০ লাখ টাকার অনুদান।

শাকিল আরো জানান, সবমিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে রানা প্লাজায় আহত ও নিহতদের পরিবারের জন্য ২২ কোটি ১৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকার অনুদান দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারের অন্যান্য দপ্তর ও সংস্থার উদ্ধার কাজ পরিচালনায় ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।

প্রধামন্ত্রীর উদ্যোগে থাইল্যান্ড সরকারের সহযোগিতায় আহতদের মধ্যে যারা পা হারিয়েছিলেন তাদের কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে।  

শাকিল বলেন, “যে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে তা রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ববোধ ও মমত্ববোধের পরিচায়ক।”

এছাড়াও আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন উদ্ধার তৎপরতা ও অন্যান্য সেবা কাজে যুক্ত থেকেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর এই সহযোগী বলেন, “টাকার অঙ্কে এটা মাপা সম্ভব নয়।”

 

সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ

রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের তথ্য তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে।

মাহবুবুল হক শাকিল বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর ২৩টি পরিদর্শন টিম গঠন করে ইতোমধ্যে ৩৪৯৭টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। আইন অম্যান্যের জন্য ৩৯২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

গত অক্টোবরে কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক একটি আইন প্রবর্তন করেছে। মজুরি বোর্ড গঠন করে ৫৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ইতোমধ্যে কার‌্যকর হয়েছে।

রানা প্লাজা ধসের পর শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রীকে প্রধান করে সরকার ‘পোশাক শিল্প খাতের সামগ্রিক পরিবেশ উন্নয়নে’ ১১ সদস্যের একটি কেবিনেট কমিটি গঠন করে, যে কমিটির সুপারিশসমূহ কার‌্যকর করা হচ্ছে।

এ কমিটির তৈরি ‘তৈরি পোশাক শিল্পের ভবন ও অগ্নি নিরাপত্তা’ এবং ‘তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণ ও সরলীকরণ’ এর জন্য দুটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

এছাড়া নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ রক্ষা, দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রীর নেতৃত্বে আরো একটি কমিটির সুপারিশও বাস্তবায়ন চলছে বলে জানান শাকিল।

তিনি বলেন, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ৫৩০ একর জমির উপড় একটি গার্মেন্টস শিল্প পল্লী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, ইতোমধ্যে সেখানে জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে।

শ্রম আইন সংশোধন করে কারখানায় নিরাপত্তার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন কার‌্যক্রম এখন আগের তুলনায় অনেক সহজ।

বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, সরকার আরও কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার ফলে পোশাক খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

“এই সরকারের গত মেয়াদে পোশাক শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে ২১৯ শতাংশ, এতো অল্প সময়ে শ্রমিকদের এতো বেতন বৃদ্ধির ঘটনা আর কখনো ঘটেনি।”

তিনি বলেন, সরকার ন্যাশনাল অ্যাকশন প্লান বাস্তবায়ন করছে। ইউরোপিয় ইউনিয়নভূক্ত ক্রেতাদের জোট অ্যাকোর্ড ও উত্তর অ্যামেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স কারাখানার নিরাপত্তা খতিয়ে দেখতে কাজ শুরু করেছে।

এ খাতের উন্নয়নে এতো পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চলছে বলে অভিযোগ করেন আতিকুল ইসলাম।

“আগামীকাল ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক উল্টো পরে মেইড ইন বাংলাদেশ দেখিয়ে তা কিনতে অনুৎসাহিত করা হবে।”

বাংলাদেশের কিছু এনজিও ও শ্রমিক সংগঠন এর সঙ্গে জড়িত আছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “তাদের এ নেতিবাচক প্রচারণার বিরুদ্ধে আপনাদেরকে (সাংবাদিক) এগিয়ে আসতে হবে।”

নেতিবাচক প্রচারনা কারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাওয়া হলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বলেন, “নেতিবাচক প্রচারণা হলে রপ্তানি কমবে এবং এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন শ্রমিকরা। মিথ্যা প্রচারণা করে থাকলে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন সাবেক স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, সাভারের সংসদ সদস্য এনামুর রহমান এনাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক কবির বিন আনোয়ার, উপ প্রেস সচিব এম নজরুল ইসলাম ও মুহাম্মদ আশরাফুল আলম  এবং উপ সামরিক সচিব মাহবুব রশীদ।