ইতিহাসের অনন্য দিন ‘মুজিবনগর দিবস’ 

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনটি এক অবিস্মরণীয় দিন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 April 2014, 07:48 AM
Updated : 17 April 2014, 07:48 AM

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহাকুমার বৈদ্যনাথতলার আম বাগানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, এম. মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জনগণের নির্বাচিত সংসদের নেতৃত্বের সরকার পুরো বিশ্বে সামনে আত্মপ্রকাশ করে।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয় সেদিন।

সেদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রচার মাধ্যমের সামনে স্বাধীন দেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের পর নতুন এই সরকারকে গার্ড অফ অনার দেয়া হয়।

মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী বক্তব্য রাখেন।

সে সময়ে মেহেরপুর মুক্ত এলাকা হওয়ায় ১৭ এপ্রিল সেখানেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি হয়।

ঘোষণাপত্র পত্রে (ষষ্ঠ অনুচ্ছেদ) বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলার জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।”

ঘোষণাপত্রে  (নবম অনুচ্ছেদ) আরো বলা হয়, ‘যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ¬বী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য সেহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং উহা দ্বারা পূর্বেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি।’

শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্র প্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন বলেও ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়।

রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারীও থাকবেন বলা হয়।

মুজিবনগর সরকারে আব্দুল মান্নানকে প্রেস, তথ্য রেডিও ও চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান, মো. ইউসুফ আলীকে ত্রাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান, মতিউর রহমানকে বাণিজ্য বিভাগের প্রধান, আমিরুল ইসলামকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান এবং মেজর আব্দুর রবকে (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সরকারি উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তারা মুজিবনগর সরকারে দায়িত্ব পালন করেন। নুরুল কাদের খান, এস. এ সামাদ, খন্দকার আসাদুজ্জামান, ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ড. সাদাত হোসাইন ও ড. আকবর আলী খান তাদের মধ্যে অন্যতম।

মুজিব নগর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তৎকালীণ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা চায়।

মুজিব নগর সরকারের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। ভারতীয় সেনারা কেবল  মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণই দেননি যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জমাম দিয়ে সাহায্য করেছিলো।

দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে মুজিবনগর সরকার গঠনে যারা সহযোগিতা করেছিলেন তাদের অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বলেছেন, “বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান স্বাধীনতা। স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের নিকট সঠিকভাবে তুলে ধরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসে দেশের তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার পাশাপাশি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতিগঠনমূলক কাজে অবদান রাখবে বলে নিজের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন আব্দুল হামিদ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, “স্বাধীনতার স্বপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ এবং তদানীন্তন ইপিআরসহ সকল শ্রেণী-পেশার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে এই সরকার দীর্ঘ নয় মাস দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিত্রশক্তির সহায়তায় চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।”

“জাতির চরম দুর্দিনেও যে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ধারা ঊর্ধ্বে তুলে এগিয়ে চলা যায়- ১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসে তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে”, যোগ করেন সরকার প্রধান। 

মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে ভোর সাড়ে ৬টা থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে পতাকা উত্তোলন, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেয়া আলোচনাসভার পাশাপাশি নানা কর্মসূচি পালন করছে বিভিন্ন সংগঠন।

বনানী কবরস্থানে শহীদ জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ ও মনসুর আলী এবং রাজশাহীতে এ এইচ এম কামারুজ্জামানের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়েছে।

দিবসটি উপলক্ষে মেহেরপুরের মুজিবনগরেও ভোর ৬টা থেকে থেকে নানা কর্মসূচি চলছে।