দেশের প্রধান নিরীক্ষকের কার্যালয়ের গত অর্থবছরের প্রতিবেদনে উত্থাপিত এসব আপত্তির তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের শাস্তি চেয়েছে বেসরকারি দুর্নীতি পর্যবেক্ষক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
অনিয়মের বিষয়ে উত্থাপিত ৫৭টি আপত্তির মধ্যে ৪৭টি অনিষ্পন্ন রেখে দেয়া ২০১২-২০১৩ অর্থবছরের চূড়ান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদনে হাই কমিশনের আর্থিক ব্যয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে সরকারি বিধি লঙ্ঘন এবং অনুমোদন ছাড়া ব্যয় করা বিপুল অংকের টাকা ফেরত নেয়ারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে রয়েছে।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে লন্ডনে হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছেন মিজারুল কায়েস। এর আগে তিনি পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন। পররাষ্ট্র সচিব পদে যোগ দেয়ার আগে রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রদূত ছিলেন ৮৪ ব্যাচের এই কর্মকর্তা।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে ‘যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের শাস্তি’ দাবি করেছেন।
তিনি বলেন, “নিরীক্ষকরা নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়গুলি তুলে এনেছেন। এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সেসব বিষয় যথাযথভাবে তদন্ত করে দোষীদের ধরা।”
সরকারি নিরীক্ষকরা তাদের প্রতিবেদনে বলছেন, “সাংগঠনিক কাঠামোতে স্থানীয় ভিত্তিক হিসাবে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ১৪ জনের জনবল নিয়োজিত থাকার কথা। কিন্তু নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্থানীয় ভিত্তিক হিসাবে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সর্বমোট ২৪ জন কর্মরত আছেন।”
এবিষয়ে মিশনের দেয়া ‘জবাব গ্রহণযোগ্য নয়’ বলেছেন নিরীক্ষকরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশ লঙ্ঘন করে ব্যক্তিগত দুই গৃহকর্মীকে মিশনে নিয়োগ দিয়েছেন হাই কমিশনার।
উক্ত নিয়োগ অনুযায়ী, কেয়ারটেকার (বাংলাদেশ হাউস) পদে জনাব দ্বীন ইসলামের বেতন-ভাতা বাবদ ৮ হাজার ৮৫ ব্রিটিশ পাউন্ডের সমপরিমাণ সাত লাখ দুই হাজার ৯২০ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে এবং ক্লিনার পদে জনাব শিপন মিয়ার বেতন-ভাতা বাবদ চার হাজার চারশো ব্রিটিশ পাউন্ডের সমপরিমাণ পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার ৩০৪ টাকা দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “ব্যক্তিগত নথিপত্র ও মাসিক ক্যাশ অ্যাকাউন্ট এবং একুইটেন্স রুল পরীক্ষায় দেখা যায়, হাই কমিশন কর্তৃক জনাব দ্বীন ইসলাম ও জনাব শিপন মিয়াকে ১-২-২০১৩ তারিখে যথাক্রমে কেয়ারটেকার (বাংলাদেশ হাউস) এবং ক্লিনার পদে নিয়োগদান করা হয়।
“রাষ্ট্রদূত বা অন্য কোনো কর্মকর্তা কর্তৃক সরকারি খরচে নেয়া কোনো ভৃত্যকে মিশনে বা মিশনের বাসভবনে স্থানীয় ভিত্তিক পদে নিয়োগ করতে পারবেন না।
“গৃহভৃত্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কাজে নিযুক্ত থাকবেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তাদের বেতন-ভাতার খরচ বহন করবেন।”
হাই কমিশনার হিসেবে লন্ডন মিশনে ঢাকা থেকে যোগ দেয়ার সময় মালামাল পরিবহন বাবদ মিজারুল কায়েস অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছেন বলেও আপত্তি এসেছে।
নিরীক্ষকরা বলছেন, মালামাল পরিবহন বাবদ সব টাকা তিনি অগ্রিম নিয়েছেন। তারপরও তিনি ‘২২৫০ কেজি ব্যক্তিগত মালামাল পরিবহনের জন্য’ ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা তুলেছেন, যা প্রাপ্য নয় এবং আদায়যোগ্য।
নিরীক্ষকদের আপত্তি তোলা আলোচ্য ৪৭টি খরচের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মিশনের জবাবকে ‘সন্তোষজনক নয়’ মন্তব্য করে ব্যয়িত অর্থ ফেরত নেয়ার বা ভূতাপেক্ষ অনুমোদন নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
কয়েকটি আপত্তির জবাব ‘গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
উন্মুক্ত দর না ডেকে মিশনের স্থানীয় ভিত্তিক কর্মচারী (মালি) শাহ মোহাম্মদ বেলালের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে বলে আপত্তি তোলা হয়েছে।
এক কোটি ৩৩ লাখ টাকার বেশি মূল্যের কাজের অর্থ পরিশোধে প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে কর্মচারী বেলালের নামে চেক দেয় মিশন।
ব্যয় নিরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট রেজিস্টার চাওয়া হলে মিশনের আসবাব রেজিস্টার, বিশেষ রেমিটেন্স রেজিস্টার, ভ্রমণ ভাতা অগ্রিম রেজিস্টার, আবাসিক টেলিফোন রেজিস্টার, ছুটি রেজিস্টার, চিকিৎসা রেজিস্টার, ওভারটাইম রেজিস্টার, বেতন-ভাতা সংক্রান্ত রেজিস্টার, উৎসব ভাতা সংক্রান্ত রেজিস্টার, অন্যান্য মেরামত সংক্রান্ত রেজিস্টার ও ডেড স্টক রেজিস্টার উপস্থাপন করেনি কর্তৃপক্ষ।
এই আপত্তির জবাবে মিশন বলেছে, “হিসাব শাখায় ৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত ছিল, বর্তমানে ২ জন কর্মরত থাকায় উল্লেখিত রেজিস্টারসমূহ সংরক্ষণ করা যায়নি।”
নিরীক্ষকদের সামনে উপস্থাপিত না হওয়ায় রেজিস্টারগুলোর সংশ্লিষ্ট সব ব্যয়ের ক্ষেত্রেই আপত্তি আছে প্রতিবেদনে।
নিরীক্ষা মন্তব্যে কর্তৃপক্ষের জবাব ‘গ্রহণযোগ্য নয়’ জানিয়ে বলা হয়েছে, “এতে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রতিফলিত হয়।”
মিশনের ব্যয়ের ক্ষেত্রে নিরীক্ষকদের অন্যতম আপত্তি ছিল গাড়ি মেরামতের খরচে।
আপত্তিতে বলা হচ্ছে, রেকর্ড যাচাইয়ে দেখা যায় যে, পরিশিষ্টে বর্ণিত ১৯টি ভাউচারের মাধ্যমে ৩৪ লাখ টাকার বেশি খরচ করে সাতটি গাড়ি মেরামত করা হয়েছে।
“একই গাড়ি এক মাসে একাধিকবার মেরামতসহ এবং স্বল্প সময় ব্যবধানে একই গাড়ি বারবার মেরামতের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
কনস্যুলার আয়ের তালিকা যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করা ও যথাস্থানে জমা না দেয়া এবং ওয়েজ আর্নার্স তহবিলের টাকা নিয়ম না মেনে খরচ করার আপত্তিও আছে প্রতিবেদনে।
আপত্তি উঠেছে মিশনের ক্রয় প্রক্রিয়াতেও, প্রতিবেদনে যা চিহ্নিত আছে সরকারি নানা বিধিবিধানের লঙ্ঘন হিসাবে।
চিকিৎসা ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিশদ বিবরণ চেয়েও পাননি নিরীক্ষকেরা।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মিশনের ডিপ্লোমেটিক উইংয়ে বরাদ্দের ৮ দশমিক ২ শতাংশ, কমার্শিয়াল উইংয়ে ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং প্রেস উইংয়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি খরচ করা হয়েছে।
মন্তব্য করা হয়েছে, “বাজেটের সীমা অতিরিক্ত ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ ব্যয় সাধিত হয়েছে।”
এই কূটনীতিকের বিরুদ্ধে একগাদা অভিযোগ থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ঘটনাগুলোকেই প্রতিবেদনে তুলে ধরার জন্য বেছে নিয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, “নিরীক্ষা প্রতিবেদনে হাই কমিশনারের প্রথম ছয় মাস মেয়াদের বিষয়গুলোই তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া আরো অনেক বেশি ব্যয়ের ঘটনা আছে, যা স্পষ্টতই বিধির লঙ্ঘন।”