সাঈদীর আপিল: যুক্তিতর্কের কেন্দ্রে দুই হত্যার ঘটনা

মুক্তিযুদ্ধের সময় ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালী হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে আগুন দেয়ার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড হলেও আপিল শুনানিতে উভয়পক্ষের ‍যুক্তিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দুই অপরাধ।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2014, 04:42 PM
Updated : 16 April 2014, 04:42 PM

প্রায় ৫০ কার্যদিবসের শুনানির শেষে দিকে কেবল ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালী হত্যার ঘটনা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয় উভয়পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে।

আপিলের শুনানি শেষে আপিল বিভাগ রায়ের জন্য অপেক্ষমান রেখেছে আপিল বিভাগ। এখন আপিল বিভাগ যে কোনো দিন চূড়ান্ত রায় দিতে পারে।  

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের আনা ২০টি অভিযোগের মধ্যে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়ার দুটি অভিযোগে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

তার বিরুদ্ধে আনা আরো ছয়টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও ফাঁসির আদেশ হওয়ায় সেগুলোতে কোনো দণ্ড দেয়নি আদালত।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, ৯ সাক্ষীর উপস্থাপিত প্রমাণাদি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৭১ সালের ৮ মে পাকিস্তান সেনারা বেশ বড় একটি রাজাকার দল নিয়ে মানিক পসারীর বাড়ি যায়, যে দলে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীও ছিলেন।

ওই বাড়ি থেকে রাজাকাররা ইব্রাহিম ওরফে কুট্টি এবং মফিজ উদ্দিন পসারীকে ধরে নিয়ে আসে। পারেরহাট রাজাকার ক্যাম্পের পথে একটি ব্রিজের নিকটে পাকিস্তানি সেনারা ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে এবং মফিজ উদ্দিনকে ক্যাম্পে এনে নির্যাতন করে। রাতে মফিজ উদ্দিন রাজাকারদের হাত থেকে পালাতে সক্ষম হয়।

রাষ্ট্রপক্ষের ৭ নম্বর সাক্ষী মফিজ উদ্দিন পসারী ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী। রাজাকার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে ভাগ্যক্রমে তিনি জীবন বাঁচাতে পেরেছিলেন।

ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যায় আসামিপক্ষের যুক্তি খণ্ডনের প্রমাণ সংগ্রহে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে ছুটে যেতে হয়েছে পিরোজপুরে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “আশা করি ২টি অপরাধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকবে এবং পাশাপাশি প্রমাণিত বাকি ৬ অপরাধেও শাস্তি দেয়া হবে।

“৬ অপরাধে আমরা সুনির্দিষ্ট করে মৃত্যুদণ্ড বা কোনো শাস্তি চাইনি। তবে শাস্তি চেয়েছি। আদালতকে আর্জিতে বলেছি, তারা যেন সন্তুষ্টি অনুসারে শাস্তি দেন।”

অন্যদিকে সাঈদীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, “দুটি চার্জে সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অভিযোগে যে স্থান ও সময়ের উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা প্রকৃত স্থান ও সময়ের সম্পূর্ণ বিপরীত।

“ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যার অভিযোগে একটা মামলা হয়েছে, সেখানেও এটা উঠে এসেছে। এ কারণে আমরা ওই মামলার জিআর নথি তলব করতে বলেছি। আদালত আমাদের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন।

ফাইল ছবি

সাঈদীর বিরুদ্ধে ১০ নম্বর অভিযোগে বিসাবালীকে হত্যা ও উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ায় আগুন দেয়ার অভিযোগ আনা হয়।

রায়ে এ বিষয়ে বলা হয়েছিল, “ইন্দুরকানি থানার উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ায় হানা দিয়ে বিসাবালী হত্যা ও ২৫টি ঘরে আগুন দেয়ার ঘটনা প্রমাণে প্রসিকিউশন ৩ জন সাক্ষীর উপস্থাপিত প্রমাণাদি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন।

অভিযুক্ত সাঈদী ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এটা ঘটিয়েছিল। প্রসিকিউশনের ১, ৫ ও ৯ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাঈদীসহ স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে উমেদপুর গ্রামের হিন্দু পাড়া আক্রমণ করে মূল্যবান মালামাল লুটপাট করে। সেখানে তারা অজ্ঞাতনামা বেসামরিক ব্যক্তিদের ২৫টি বসবাসের ঘরে আগুন দেয়।”

“এটা স্পষ্ট যে, রাজাকাররা বিসাবালী নামে এক বেসামরিক ব্যক্তিকে ধরে নির্যাতন করে। এরপর তাকে নারিকেল গাছের সঙ্গে বাঁধা হয়। পরে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর প্ররোচনায় তাকে সেখানে রাজাকাররা গুলি চালিয়ে হত্যা করে।”

প্রসিকিউশনের পাঁচ নম্বর সাক্ষী মাহতাবউদ্দিন হাওলাদার ও নয় নম্বর সাক্ষী আলতাফ হোসেন হাওলাদার চাক্ষুস সাক্ষী হিসেবে অভিযুক্তের প্ররোচনায় বিসাবালীকে হত্যা ও হিন্দুপাড়ায় আগুন দেয়ার বিষয়টি প্রমাণ করেছেন বলে ট্রাইব্যুনাল জানায়।

বিসাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালীর বক্তব্য ট্রাইব্যুনালে দেয়া হয়েছে জানিয়ে সাঈদীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব বলেন, “তিনি (সুখরঞ্জন) ট্রাইব্যুনালে এসে মিথ্যা সাক্ষী দিতে চাননি। তিনি আমাদের পক্ষে সাক্ষী দিতে চেয়েছেন।

“আমরা তাকে নিয়েও এসেছিলাম। কিন্তু সাদা পোশাকে তাকে ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে অপহরণ করা হয়েছে। সত্য কথা বলতে গিয়ে তিনি আজ ভারতে কারাগারে বন্দি রয়েছেন।”

ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালত সুখরঞ্জন বালীর বক্তব্য বিবেচনায় নেবে বলে আশা করেন তিনি।

ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে গত ২৮ মার্চ আপিল করেন সাঈদী। অন্যদিকে সাজা না হওয়া ছয় অভিযোগে এই জামায়াত নেতার শাস্তি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।