হাওরে শিলা বৃষ্টি, বিষণ্ন বোরো কৃষক

হাওর সমৃদ্ধ এলাকা কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে এখন পাকা বোরো ধান। কয়েকদিন পরই শুরু হবে এ এলাকার কৃষকদের একমাত্র ফসল এ বোরো ধান কাটা।

মারুফ আহমেদ কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2014, 04:25 PM
Updated : 17 April 2014, 03:39 AM

খাওয়া, পরা থেকে শুরু করে কৃষকের সারা বছরের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের একমাত্র উৎস বোরো ধান। তাই এ সময়টির জন্য কৃষকদের দিন যেন আর কাটে না। কখন আসবে ফসল তেলার সেই আকাঙ্ক্ষিত দিন, একটু হাসির দিন। এজন্য চলছে তাদের ফসল তোলার প্রস্তুতি।

কৃষকের এই খুশির সময়ে প্রচণ্ড আঘাত হয়ে এসেছে বৈশাখি শিলাবৃষ্টি। এছাড়া এবার যোগ হয়েছে ধানের চিটা। এ আনন্দঘন সময়েও তাই কৃষকের মুখে বিষাদের ছায়া।

চলতি সপ্তাহে তিন বার প্রবল শিলাবৃষ্টির কারণে জেলার মিঠামইন ও ইটনা উপজেলার অন্তত ৩০টি গ্রামে পাকা বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে অর্ধেকেরও বেশি ধান নষ্ট হয়ে গেছে।

গত শনিবার ইটনা ও মিঠামইনে টানা ৪৫ মিনিট প্রবল শিলা বৃষ্টি হয়েছে। এরফলে দুই উপজেলার দশটি গ্রামে পাকা বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এর আগে শিলা বৃষ্টি হয় গত বৃহষ্পতিবার। তখনও এ দুই উপজেলায় বোরো ফসলেল ব্যাপক ক্ষতি হয়। 

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মিঠামইনের ঘাঘড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বুলবুল চৌধুরী বলেন, এবার ফলন ভালো হয়েছিল। কিন্তু শিলা বৃষ্টির কারণে এ ইউনিয়নের পঞ্চাশ ভাগ ধান নষ্ট হয়ে গেছে।

এর মাঝে খলা পাড়া, মালিউন ও ভরা গ্রামের বেশিরভাগ ধানই নষ্ট হয়ে গেছে। পাশাপাশি চিটা সমস্যাও আছে।

বোরো ধান একমাত্র ফসল হওয়ায় সরকারকে কৃষকদের সহায়তার আহ্বান জানান তিনি।

ইটনার ছিলনী গ্রামের সম্পন্ন কৃষক ফুল মিয়া বলেন, তিনি ১৮ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। শিলা বৃষ্টিতে তার পাকা ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

“যেখানে আমি কমপক্ষে এক হাজার মন ধান পেতাম, সেক্ষেত্রে চার শত মনের বেশি ধান পাব না,” বলেন তিনি।

শিলা বৃষ্টির পাশাপাশি চিটা ধান হওয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইটনার বড়ি বাড়ি, এলংজুড়ি, জয় সিদ্ধি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। এসব স্থানে হাইব্রিড ও আগাম জাতের ব্রি-২৮ ধান চিটা হয়ে অর্ধেকই নষ্ট হয়ে গেছে। 

জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনির হোসেন, এলংজুড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুছ ও বড়ি বাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হারেছ মিয়া বলেন, তাদের এলাকায়  আগাম জাতের ব্রি-২৮ ধান শতকরা আশি ভাগ এবং হাই ব্রিড জাতের ধান চল্লিশ ভাগের মত নষ্ট হয়ে গেছে।

ইটনা উপজেলার পশ্চিমপাড়া গ্রামের কৃষক শেখ ফরিদ উদ্দিন বলেন, তিনি চার একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। কিন্ত চিটার কারণে আশি ভাগ ধানই নষ্ট হয়ে গেছে।

“যেখানে আমি কমপক্ষে তিন শত মন ধান পেতাম, সেক্ষেত্রে পঞ্চাশ মন ধানও পাব না,” বলেন ফরিদ।

শিমুলবাক গ্রামের ওসমান ভুইয়া বলেন, ছয় একর জমির ধান চিটায় নষ্ট হয়ে গেছে। চারশ মনের জায়গায় একশ মনও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে।

তবে, সঠিক সময়ে বীজ তলা তৈরি না করা ও চারা রোপনে সমস্যাই হলো চিটা ধান হওয়ার মূল কারণ।

এ ব্যাপারটি কৃষকদের অবহিত করতে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে ওসমান ভুইয়া অভিযোগ করেন।

স্থানীয়রা জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বোরো ধান চাষ চাষিরা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে থাকে।

এমন একজন হলেন বড়ি বাড়ী গ্রামের সাদী মিয়া, যিনি শতকরা পঞ্চাশ ভাগ সুদে চার মাসের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার নিয়ে পঁচিশ একর জমিতে বোরো চাষ করেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে চলতি মৌসুমে ইটনা ও মিটামইন উপজেলায় ১২ হাজার, ৯১৬ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ও আগাম জাতের জাতের বোরো ধান আবাদ হয়েছে, যা থেকে ৬৭ হাজার ৮০৯ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

হাওর এলাকার বাসিন্দা ঢাকায় সার্ক এগ্রিকালচার সেন্টারের সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার কৃষি প্রযুক্তিবিদ ড. মো. নিয়াজ উদ্দিন পাশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চিটার পর শিলা বৃষ্টিতে পাকা ধান মাটিতে মিশে যাওয়ায় কৃষকের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।

গত শনিবার (১২ এপ্রিল) ফসলের মাঠে কয়েক ইঞ্চি পুরু শিলার স্তর পড়েছে।

তিনি চিটার হাত থেকে রক্ষা পেতে গবেষণার মাধ্যমে বোরো ধানের বীজতলা তৈরি ও চারা বপনের সঠিক সময় নির্ধারণ করে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে তা কৃষকদের অবহিত ও উদ্বুদ্ধকরণের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহবান জানান।

এছাড়া ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ নির্ণয় করে কৃষকদের পুনর্বাসনে পদক্ষেপ গ্রহণেরও অনুরোধ জানান তিনি।

তবে স্থানীয় কৃষক, জন প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের কথা আমলে নিতে নারাজ কৃষি বিভাগ।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নির্মল কুমার সাহা চিটা ও শিলা বৃষ্টিতে বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা স্বীকার করলেও তিনি বলেন, প্রকৃতির বিরূপ আচরণ হাওরের জন্য নৈমত্তিক ঘটনা।

এছাড়া সঠিক সময় না জেনে ধান রোপনের ফলে কোল্ড ইনজুরির কারণে চিটা হয়ে থাকে।

এ সমস্ত কারণে কিছু ধান নষ্ট হলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমস্যা হবে না বলে তিনি দাবি করেন।

এছাড়া সঠিক সময়ে বীজ তলা তৈরি ও চারা রোপনে কৃষি বিভাগের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, “আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সব সময়ই পহেলা অগ্রহায়ন থেকে পনেরো অগ্রহায়নের মধ্যে বীজতলা তৈরির জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেই। কিন্তু কৃষকরা আগাম বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশংকায় আগেভাগে বীজতলা তৈরি ও চারা বপন করায় চিটার সমস্যা দেখা দেয়।”