‘বাবাকে প্রথম কোপ দিয়েছিল সুবহান’

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আব্দুস সুবহান ও তার সহযোগীরা একাত্তরে ইশ্বরদীতে মোয়াজ্জেম হোসেন নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেন বলে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যে বলেছেন তার ছেলে তহুরুল আলম মোল্লা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 April 2014, 07:42 PM
Updated : 15 April 2014, 08:25 PM

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ মঙ্গলবার সাক্ষ্য দেন ৬২ বছর বয়সী তহুরুল। এ মামলায় প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিলেন তিনি।

সাক্ষ্যে তহুরুল বলেন, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বিকালে ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে তার বাবা মোয়াজ্জেম হোসেনকে একটি ছোরা দিয়ে প্রথম আঘাতটি করেন আব্দুস সুবহান। পরে তার সহযোগীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তার বাবাকে হত্যা করে।

জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীও ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন তিনি।

তহুরুল বলেন, ওই মসজিদের সামনে তার মামা হাবিবুর রহমান, ফুপাতো ভাই মতলেব আহমেদ খান ও  তার ছেলে নাজমুল হক খানকেও একইভাবে কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যা করা হয়।

এর আগে নিজামীর মামলায়ও সাক্ষ্য দেন তহুরুল।

১৯৭১ সালে ১৯ বছর বয়সী এ সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালে বড় ভাই জহুরুল আলম ঈশ্বরদী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক  এবং মামা ফকির নুরুল ইসলাম ঈশ্বরদী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। সেই সূত্রে তিনি জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা খোদা বকস খান, মতিউর রহমান নিজামী ও আব্দুস সুবহানকে চিনতেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশনামূলক এক বক্তৃতা দেন। এরপর আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিগুলোর সমন্বয়ে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। স্থানীয়ভাবে বাঁশের লাঠি ও বিভিন্ন জনের লাইসেন্স করা অস্ত্র সংগ্রহ করে প্রস্তুতি নেয়া হয়।

তহুরুল বলেন, ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর জামায়াতে ইসলামী, নেজামে  ইসলামীর লোকজন পাবনা জেলা পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে। এরপর সাধারণ জনগণ ও পুলিশের প্রতিরোধের মুখে ২৯ মার্চ পাকসেনারা টিকতে না পেরে পাবনার মানসিক হাসপাতালের পিছনের চর এলাকা দিয়ে ঈশ্বরদীর দিকে এগোতে থাকে।

জামায়াত নেতা আব্দুস সুবহান।

এসময় মাতপুর এলাকায় এবং ঈশ্বরদীর দাশুরিয়ায় প্রতিরোধকারীদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ হয় পাকসেনাদের। দাশুরিয়ার যুদ্ধে নিজে অংশ নেন বলে জানান সাক্ষী।

তিনি বলেন, “দাশুরিয়ায় যুদ্ধের পরে পলায়নরত পাকসেনা ও তাদের দোসররা গোপালপুর সুগার মিলে আশ্রয় নেয়। ওই সময় তারা ওই মিলের ম্যানেজার আজিম সাহেবসহ বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হত্যা করে।”

তখন থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা ও ঈশ্বরদী পুরো এলাকাটি সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এরপর ১১ এপ্রিল বিকালে ঈশ্বরদীতে ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। পরদিন ঈশ্বরদীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও বিহারীরা ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে।

ওই সময় ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তার বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন, মামা হাবিবুর রহমান, ফুপাতো ভাই মতলেব আহমেদ খান ও ভাতিজা নাজমুল হক খান হেলাল আশ্রয় নেন বলে জানান সাক্ষী।

তহুরুল বলেন, বাবাসহ ঈশ্বরদীতে আটকে পড়া অন্যদের তিলকপুর নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ১৩ এপ্রিল সকালে ফজলুর রহমান ফান্টু নামের এক বন্ধুকে নিয়ে ঈশ্বরদীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি।

ঈশ্বরদী জামে মসজিদের পাশে ফুপুর বাসায় ঢুকতে গেলে স্থানীয় এক বৃদ্ধের কাছে জানতে পারেন, মসজিদের পাশে এক পরিত্যক্ত ঘরে নির্যাতন কেন্দ্র খুলে জামায়াত নেতা খোদা বক্সের নেতৃত্বে তালিকা তৈরি করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। মাওলানা সুবহান ও মতিউর রহমান নিজামীর পরামর্শে এসব হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে খোদা বক্স ও তার লোকজন।

‍“ওই বৃদ্ধ আমাকে আরো জানিয়েছিলেন, ১২ এপ্রিল সুবহান মওলানা ও মতিউর রহমান নিজামীর পরামর্শক্রমে খোদা বক্স ও তার লোকজন আমার মামা হাবিবুর রহমানকে মসজিদ থেকে বের করে নিয়ে হত্যা করেছে। একথা শোনার পরে গন্তব্যের দিকে না গিয়ে মসজিদের কাছ থেকেই তিলকপুরের দিকে চলে আসি আমরা।”

তিনি বলেন, ১৭ এপ্রিল আবারো বন্ধু ফান্টুকে নিয়ে ঈশ্বরদী যান এবং বিকালে মসজিদের  কাছে পৌঁছান। জায়গাটি গাছ-গাছালিতে ভরা। এরই দক্ষিণ দিকে পরিত্যক্তে একটি ঘরে নির্যাতন কেন্দ্র বানানো হয়েছিল।

“‍ঘরটির সামনে একটি সাদা গাড়ি দেখতে পাই। সেখানে মাওলানা সুবহান, মতিউর রহমান নিজামীকে গাড়ি থেকে নেমে ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেখি।

“এর কিছুক্ষণ পর খোদা বক্সসহ সুবহান ও মতিউর রহমান নিজামী মসজিদে নামাজ পড়তে ঢুকেন। নামাজ শেষে তারা বেরিয়ে আসার পরে পরিত্যক্ত ঘরটির সামনে দাঁড়ায়। এরপর তারা বাবাকে মসজিদ থেকে টানতে টানতে বের করে মসজিদের পাশে কয়লার ডিপোর পাশে একটি গর্তের মতো জায়গায় নিয়ে যায়।”

কাঁদতে কাঁদতে বাবার হত্যার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “‍মওলানা সুবহানও সেখানে যায়। মতিউর রহমান নিজামী ঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সুবহান একজনের কাছ থেকে একটি ছোরা নিয়ে বাবাকে আঘাত করতেই তিনি আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। এরপর সুবহানের সহযোগীরা বাবাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে এবং এরই এক পর্যায়ে তার মৃত্যু হয়।”

এরপর ১৮ এপ্রিল বাবার লাশ আনার উদ্দেশ্যে গিয়ে একই স্থানে, একইভাবে সাক্ষী তার ফুপাতো ভাই মতলেব আহমেদ খান ও তার ছেলে নাজমুল হক খান হেলালকে নৃশংসভাবে হত্যা করতে দেখেন বলে ট্রাইব্যুনালে জানান।

‍সাক্ষ্য দেয়ার এক পর্যায়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আব্দুস সুবহানকে সনাক্ত করেন সাক্ষী। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি দিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সাক্ষ্য শেষে তাকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। পরে জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় বুধবার পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম মুলতবি রাখা হয়।

এর আগে গত ২ এপ্রিল সুবহানের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন।

গত ২৭ মার্চ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন  ট্রাইব্যুনাল-১ স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করে।

গত ৩১ ডিসেম্বর সুবহানের বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন ও লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের নয়টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল-১।

২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাশ থেকে সুবহানকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।