ঢাকার বিশেষ জজ-৩ বাসুদেব রায় বুধবার খালেদার উপস্থিতিতে ‘জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট’ ও ‘জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট’ দুর্নীতি মামলায় অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর জন্য ২১ এপ্রিল দিন ঠিক করে দেন।
এতিমখানা ট্রাস্ট মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে খালেদা, তারেকসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে। আর জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে আসামি হিসাবে রয়েছেন আরো তিনজন।
খালেদা জিয়ার পক্ষে সময়ের আবেদন করা হলেও তা নাকচ হয়ে যায় বলে তার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন জানান।
সময়ের আবেদন খারিজ হয়ে গেলে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের হট্টগোলে দুই দফা এজলাস থেকে নেমে যান বিচারক। আইনজীবীরা পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে তাও খারিজ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে এ আদালতের প্রতি অনাস্থাও প্রকাশ করেন খালেদার আইনজীবীরা।
পরে খাস কামরায় বসে বিএনপি চেয়ারপারসন ও অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারক।
অভিযোগ গঠনের পর আদালত কক্ষে নিজের আইনজীবীদের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন খালেদা। তিনি বলেন, “কই আমাকে তো কিছু জিজ্ঞেস করা হলো না- আমি দোষী, না নির্দোষ। আমাকে চার্জ পড়েও শোনানো হলো না।”
আদালতের আদেশের পর খালেদার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নাইকো, গ্যাটকো, খনি দুর্নীতি- কোনো মামলাতেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়নি। অদ্ভুত এবং নাটকীয়ভাবে এই প্রথম কোনো মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হলো। আমরা এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব।”
দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজলও জানান, এর আগে খালেদা কোনো মামলায় অভিযুক্ত হননি। এ দুই মামলায় অভিযোগ গঠনের ক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যাত্যয় হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
জিয়া দাতব্য ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগে ২০১১ সালে এবং জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টে অনিয়মের অভিযোগে ২০০৮ সালে মামলা দুটি দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন।
এর মধ্যে দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দুদকের দেয়া অভিযোগপত্র গত বছর ১৫ জানুয়ারি গ্রহণ করে আদালত। সর্বশেষ ওইদিনই আদালতে হাজির হয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা।
তার আইনজীবীদের আবেদনে এতিমখানা মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি ৪১ বার এবং দাতব্য ট্রাস্ট মামলার শুনানি ১১ বার পিছিয়ে যায়।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে হাজির হওয়ার জন্য শেষবারের মতো সময় দেন বিচারক। ওইদিন আদালতের আদেশে বলা হয়, ১৯ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসন আদালতে না এলে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হতে পারে।
জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার অপর আসামিরা হলেন- খালেদার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
এদের মধ্যে হারিছ চৌধুরী মামলার শুরু থেকেই পলাতক। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে। খালেদাসহ বাকি দুই আসামি জামিনে রয়েছেন।
আর এতিমখানা ট্রাস্ট মামলার অপর আসামিরা হলেন- বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।
তারেক রহমান উচ্চ আদালতের জামিনে গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন। সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিন আছেন জামিনে। বাকি দুজন পলাতক।
আড়াই ঘণ্টার শুনানি, দফায় দফায় হট্টগোল
অভিযোগ গঠনের শুনানিতে অংশ নিতে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গুলশানের বাড়ি থেকে পুরান ঢাকার আদালতপাড়ার দিকে রওনা হন খালেদা। এরই মধ্যে আদালত প্রাঙ্গণে মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ।
এদিকে খালেদা পৌঁছানোর আগেই বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে আদালত পাড়ায় জড়ো হন বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, যিনি কয়েকদিন আগে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। বিএনপি নেতা-কর্মীদের এ সময় শ্লোগান দিতেও দেখা যায়।
সাদা একটি গাড়িতে করে খালেদা জিয়া আদালত প্রাঙ্গণে পৌঁছান বেলা ১টার দিকে। এরপর তিনি সোজা ছয় তলায় বিশেষ জজ-৩ এর এজলাসে উঠে যান এবং তার জন্য এনে রাখা চেয়ারে বসেন।
এ সময় আদালত কক্ষে দাঁড়ানো নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবী এবং খালেদার নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যে কিছুটা বাক বিতণ্ডা হয় এবং ধাক্কা-ধাক্কি হয়।
এর আগেই খালেদার পক্ষে তার আইনজীবীরা অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য আরো সময়ের আবেদন করেন।
আবেদনে বলা হয়, এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা খারিজে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল এবং দাতব্য ট্রাস্ট মামলায় হাই কোর্টে খালেদার পুনর্বিবেচনার আবেদন শুনানির অপেক্ষায়।
ওই শুনানি না হওয়া পর্যন্ত বিচারিক আদালতে অভিযোগ গঠনের শুনানি স্থগিত রাখা হোক।
বেলা সোয়া ১টার দিকে আসামিপক্ষের তুমুল হৈ চৈ-এর মধ্যেই শুনানি শুরু হয়।
দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল আসামি পক্ষের বার বার সময় চাওয়ার তারিখগুলো পড়ে শোনান এবং আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আবেদন করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতের কোনো স্থগিতাদেশ আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। মামলা দুটো ঝুলিয়ে রাখার জন্য তারা বছরের পর বছর নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন।
অন্যদিকে খালেদার আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা কোনো বিষয়ে এ আদালত সিদ্ধান্ত দিতে পারে না।
শুনানির এ পর্যায়ে বিচারক সময়ের আবেদন খারিজ করে দিলে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা হৈ চৈ শুরু করেন এবং খালেদা জিয়ার সামনেই বিচারকের প্রতি কটূক্তি করতে থাকেন।
বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের নেতা সানাউল্লাহ মিয়া ও মাসুদ আহমেদ তালুকদার বার বার চেষ্টা করে হট্টগোল থামানোর পর আবার আবার শুনানি শুরু হয়।
বিচারকের মঞ্চের সামনে চেয়ারে বসে খালেদা জিয়া এ সময় চুপচাপ আইনজীবীদের বক্তব্য শুনছিলেন। মাঝেমধ্যে তাকে চোখ বুঁজেও থাকতে দেখা যায়।
খালেদার অপর আইনজীবী ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মহসীন মিয়া বিচারককে বলেন, “দুই পক্ষকেই কথা বলতে দিতে হবে।… সময়ের আবেদন মঞ্জুর করা হোক, অভিযোগ গঠন আজ হবে না।”
এক পর্যায়ে এ আইনজীবীরা ‘এ আদালতের প্রতি আস্থা নেই বলে চিৎকার শুরু করেন। এই হট্টগোলের মধ্যে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে বিচারক এজলাস থেকে নেমে খাসকামরায় চলে যান।
পরে বিচারকের পক্ষে এ আদালতের পেশকার এজলাসে এসে জানান, এক ঘণ্টা পর আদেশ দেয়া হবে।
কি আদেশ আসতে পারে আন্দাজ করে সময়ের আবেদন নাকচের আদেশ পুর্নবিবেচনা এবং এ আদেশের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে যাওয়া হবে বলে আদেশ স্থগিত রাখার দুটি আবেদন বিচারকের খাস কামরায় পাঠিয়ে দেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
এ সময় দেড় ঘণ্টার বেশি সময় বিএনপি চেয়ারপারসনকে আদালত কক্ষে বসে থাকতে হয়।
ক্লান্ত কি না জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে খালেদা বলেন, “না, না, সব ঠিক আছে।”
সঙ্গে ওষুধ এনেছেন কি না- জানতে চাইলে বলেন- আনেননি।
পরে আসামি ও দুইপক্ষের আইনজীবীকে পেশকারের মাধ্যমে খাস কামরায় ডাকেন বিচারক। এ সময় পাঁচ আইনজীবী খাসকামরায় ঢুকে পড়েন এবং কোনো আদেশ না পেয়ে এজলাসে ফিরে আসেন। অপেক্ষা ও হৈ চৈয়ের পালা শুরু হয় আবার।
বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে আবারো এজলাসে আসেন বিচারক। খালেদার আইনজীবীরা এ সময় তার কাছে আদেশ প্রার্থনা করেন।
এ পর্যায়ে দুদকের আইনজীবীর সঙ্গে আসামিপক্ষের আবার বাক বিতণ্ডা হয় এবং বিচারক ফের এজলাস ছেড়ে খাস কামরায় চলে যান।
কিছুক্ষণ পর পেশকার ঘোষণা করেন, আগামী ২১ এপ্রিল দুই মামলাতেই সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ আদেশের সঙ্গে সঙ্গে টেবিল থাবড়ে চিৎকার করতে থাকেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। তারা ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে বিচারকেকে নিয়ে কটূক্তিও করেন।
বিএনপি নেতাদের মধ্যে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, সাদেক হোসেন খোকা, শিমুল বিশ্বাস, আসিফা আশরাফি পাপিয়া ও আজম খান এ সময় এজলাসে উপস্থিত ছিলেন।
বিকাল ৩টা ৫১ মিনিটে খালেদা লিফটে করে নিচে নেমে এলে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল করেন।
মামলা বৃত্তান্ত
২০১০ সালের ৮ অগাস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ চার জনের বিরুদ্ধে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ।
তেজগাঁও থানার এ মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।
২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
আর জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টে অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় অন্য মামলাটি দায়ের করে।
এতিমদের সহায়তার জন্য একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় এ মামলায়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ ২০১০ সালের ৫ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেন।