ভবিষ্যতে এ ধরনের লেখা ছাপাতে প্রথম আলোসহ অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমকে সতর্কও করে দিয়েছে আদালত।
নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে একই অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।
আদালত অবমাননার অভিযোগে মতিউর রহমান ও মিজানুর রহমান খানের বিরুদ্ধে দুটি রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের বেঞ্চ এ রায় দেয়।
দুপুর আড়াইটায় আইনজীবী ও সাংবাদিকে ঠাসা আদালতকক্ষে রায়ের সময় মিজানুরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
শুনানি ও রায়ের পাঁচদিন আদালতে দাঁড়িয়ে থাকাকে দণ্ড হিসাব করে নগদ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে মিজানুরকে।
আদালত রায়ে বলেছে, “অবমাননামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করে মিজানুর গুরুতর আদালত অবমাননা করেছে। এ জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার সময়কে দণ্ড হিসাবে গণ্য করেছে।
“জনাব খান অনুধাবন করেছেন যে, তিনি এই গুরুতর অবমাননাকর লেখার মাধ্যমে গুরুতর আদালত অবমাননা করেছেন এবং গত ১১ মার্চ শুনানির মাঝপথে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং আদালতে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। দেরিতে হলেও ক্ষমা চাওয়ায় আদালত তাকে আর বাড়তি সময়ের দণ্ড দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। তবে আদালত অবমাননার দায়ে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হলো।”
এর আগেও মিজানুর রহমান খান কয়েকটি আদালত অবমাননাকর নিবন্ধ লিখেছেন এবং সেগুলো এখনো বিচারাধীন রয়েছে বলে আদালত রায়ে উল্লেখ করেছে।
সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত আদালতের সহজাত ক্ষমতাবলে কোর্ট অব রেকর্ড হিসেবে এ দণ্ড দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে আদালত।
রায়ে মিজানুরের উদ্দেশ্যে আদালত বলেছে, “আদালত এই বিষয়টিকে নথিভুক্ত করে রেখে অবমাননাকারীকে সতর্ক করে দিচ্ছে, যাতে তিনি ভবিষ্যতে আদালতের কর্তৃত্ব ও বিচারকদের নিয়ে আক্রমণাত্মক কোনো নিবন্ধ না ছাপেন বা কোনো মন্তব্য না করেন।
“প্রথম আলোর সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর মতিউর রহমানের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং তাকে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।”
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মিজানুর রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে তিনি পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।
তবে রায়ের পর প্রথম আলো সম্পাদকের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
গণমাধ্যম শৃঙ্খলের উর্ধ্বে নয়
রায়ে প্রেস স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণও দিয়েছে আদালত।
আদালত বলেছে, “পরিশেষে বলা যায় যে, নাগরিকদের মত প্রকাশের প্রধানতম মাধ্যম হলো প্রেস। বলা হয়ে থাকে যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র নিশ্চিত হতে পারে এবং সমালোচনার মাধ্যমেই গণতন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো সচল থাকতে পারে।
“তবে অন্য যে কোনো অধিকারের মতোই এই অধিকারটিও শৃঙ্খলের উর্ধ্বে নয়। আদালতের উপর আস্থা চলে গেলে আইনের শাসনও বিঘ্নিত হবে।”
আদালত বলেছে, “এটা প্রত্যাশিত যে, প্রথম আলোর মতো বিখ্যাত দৈনিক এবং অন্যান্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নামে আদালতকে প্রশ্ন করে নিবন্ধ ছাপানোর বিষয়ে সাবধান থাকবে।”
রায়ের আগে আইনজীবীদের সারিতে বসে থাকা মিজানুরকে ডেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
এরপর বুধবার সাত সাংবাদিক ও দুটি পত্রিকার আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতির কারণ নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত শাহদীন মালিকের বক্তব্যের জন্য তাকে ভর্ৎসনা করে আদালত।
এরপর রায় পড়া শুরু হয়। অবশ্য রায়ের পর বিচারকরা স্বল্প বিরতিতে এজলাস ত্যাগ করলে মিজানুর কাঠগড়া থেকে নেমে যাওয়ার সুযোগ পান।
তবে আইনজীবীর পরামর্শে তিনি কাঠগড়া ত্যাগ না করে দাঁড়িয়ে থাকেন।
কিছুক্ষণ পর বিচারকরা এসে মিজানুরকে দাঁড়ানো দেখে বলেন, “মি. মিজানুর রহমান খান, আপনি চলে যেতে পারেন।”
দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত দুটি লেখা নিয়ে গত ২ মার্চ পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানকে তলব করে হাই কোর্টের এই বেঞ্চ।
এর মধ্যে একটি লেখার শিরোনাম ছিল- ‘মিনিটে একটি আগাম জামিন কীভাবে?” একই বিষয়ে অন্য লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘ছয় থেকে আট সপ্তাহের স্বাধীনতা’।
তলবের পাশাপাশি ওই দিন দুটি রুল জারি করে আদালত, যার একটিতে কেবল মিজানুর এবং অন্যটিতে মিজানুরের সঙ্গে প্রথম আলো সম্পাদককেও বিবাদি করা হয়। আদালত অবমাননার অভিযোগে কেন তাদের শাস্তি দেয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় এই রুলে।
আদালতের আদেশে গত ৬ মার্চ হাজির হয়ে লিখিত হলফনামা দেন মিজানুর। ৯, ১০ ও ১১ মার্চ তার উপস্থিতিতেই এ বিষয়ে শুনানি হয়। হলফনামার বিষয়ে নিশ্চিত হতে আদালত প্রথম আলো সম্পাদকের বক্তব্য শুনতে চাইলে তিনিও গত মঙ্গলবার হাজির হন।