‘মিজানুর সেনানিবাসের দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা করছেন’

প্রথম আলোর একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগের শুনানিকালে শীর্ষ একজন আইনজীবী বলেছেন, ওই সাংবাদিক সেনাবাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 March 2014, 03:46 PM
Updated : 6 March 2014, 04:42 PM

বৃহস্পতিবার শুনানির সময় ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, “মিজানুর রহমান খান তার তথ্য বিকৃতিমূলক লেখার মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করছেন। এটা করে আদালতকে হেয় করা হচ্ছে।”

সম্প্রতি বাংলা দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানের দুটি লেখায় আদালত অবমাননার অভিযোগের ওপর বৃহস্পতিবার শুনানি শুরু হয়।

প্রথম আলো ও এর সহযোগী ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারকে ২০০৭-২০০৮ সালের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা আরোহনের নেপথ্যে কাজ করার জন্য অভিযুক্ত করে আসছে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকে।

রোকন উদ্দিন বিভিন্ন রায়ের উদাহরণ টেনে মিজানুর রহমান খানের শাস্তির আর্জি জানান।

লেখা দুটির মাধ্যমে অবমাননা হয়েছে বলে স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল দিয়ে মিজানুরকে তলব করে আদালত।

ওই লেখায় বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে দাবি করে তিনি আদালতের আগাম জামিন দেয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

বৃহস্পতিবার মিজানুর আদালতে উপস্থিত হওয়ার পর শুনানিতে রোকন উদ্দিন মাহমুদ ছাড়াও প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকও আদালত অবমাননার অপরাধে তার শাস্তি দাবি করেন।

বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমদের বেঞ্চের সামনে ১০টা ২৫ মিনিটে পৌঁছেন মিজানুর।

১০টা ৩৯ মিনিটে দুই বিচারক এজলাসে আসেন।

এরপরই মিজানুরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অন্য কয়েকটি আবেদনের ওপর শুনানি করেন দুই বিচারক।

১১টার পরপরই আদালত অবমাননার অভিযোগের শুনানিতে অংশ নেন রোকন উদ্দিন মাহমুদ।

তিনি বলেন, “এই ব্যক্তিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তার সঙ্গে আমার ভালোই পরিচয় রয়েছে। কিন্তু এখানে আদালতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তিনি এমন একটি লেখা লিখেছেন, যাতে এমন কোনো প্যারা নাই, যেখানে কোর্টকে আক্রমণ করে নাই।

“ইদানিং দেখা যাচ্ছে, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে গেলে আসামিদেরকে জেলে পাঠানো হচ্ছে। তাই জনগণ সুপ্রিম কোর্টে আসছে। তিনি লিখেছেন মিনিটে একটি আগাম জামিন কীভাবে। তাহলে মিনিটে একজনকে জেলে ঢুকালে কি উনি খুশি হতেন?

“তিনি বলতে চাচ্ছেন, মেরিটে জামিন হয় না। অন্য কারণে হয়।”

রোকন উদ্দিন বলেন, “তিনি এমনভাবে লিখেছেন যে, ন্যায় বিচার করতে আদালত জামিন দিচ্ছেন না। অন্য কোনো কারণে জামিন দিচ্ছেন।”

লেখায় নির্দিষ্ট একটি বেঞ্চের নাম উল্লেখের বিষয়ে তিনি বলেন, “এখানে দুই বিচারপতির নাম উল্লেখ করে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।”

মিজানুর লিখেছেন, “হাইকোর্টে জামিন-ঝড় এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তবে প্রশ্ন, যে প্রতিকার সমক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচটি বেঞ্চ দিতে পারেন, তা আইনজীবীরা কেন একটি বিশেষ আদালতের কাছ থেকে নিতে ছোটেন? এর উত্তর আমরা কার কাছ থেকে পাব?”

এ বিষয়ে রোকন উদ্দিন বলেন, “উনি আমার কাছে আসলেই তো আমি বিষয়টা ব্যাখ্যা করতাম। এ কোর্টে যে আইনজীবীরা আসেন তাদের জিজ্ঞেস করতে পারতেন, কেন তারা এখানে আসেন। মনগড়া প্রশ্ন তুলে কার কাছে জবাব পাবেন, সেটাও বুঝতে পারছেন না। তার এই মনগড়া প্রশ্ন আদালতের ইন্টিগ্রিটি ও সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

“মিজানুর লিখেছেন, ‘২৯ জানুয়ারি ওই একই আদালতের কার্যতালিকায় ৪১১টি আগাম জামিন অবেদন ছাপা হয়। আবেদন মঞ্জুর হয় ২৫১টি। এখানেও অন্তত ৩০০ আসামি আগাম জামিন পান’।”

রোকন উদ্দিন বলেন, “৪১১টিতে ২৫১টি মঞ্জুর হয়েছে, সেটা তিনি লিখেছেন। কিন্তু ১৬০টি খারিজ হয়েছে, সেটা তো তিনি লেখেন নাই। এখানে তিনি তথ্য গোপন করে গেছেন।

“এরপরেই বলেছেন, এরা বিচিত্র অপরাধের আসামি। কেউ কেউ দুর্ধর্ষও হতে পারেন। তার মানে তিনি ক্রস চেক করেন নাই। সাংবাদিক তথ্য দিবে, অনুমান নির্ভর কথা বলবে না। এর মাধ্যমে তিনি তার পেশাগত নৈতিকতাও লঙ্ঘন করেছেন।”

রোকন মন্তব্য করেন, “বাংলাদেশে সাংবাদিকতার জন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। আইনজীবীদের জন্য বার কাউন্সিল আছে, ডাক্তারদের জন্য মেডিকেল কাউন্সিল রয়েছে, কিন্তু সাংবাদিকদের জন্য এ ধরনের কিছুই নাই।

“এ কারণে তাদের অনেকেই ভাবে, তারা আইনের উর্ধ্বে। তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে ব্যবহার করে যে কোনো কাউকে অভিযুক্ত এবং নাজেহাল করতে পারে।”

প্রথম আলোয় মিজানুর রহমানের ওই লেখা সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, “এটা তথ্য-বিকৃতি। এটা করে আদালতকে হেয় করা হয়েছে। আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করতেই এটা করা হয়েছে।”

এ সময় আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মামলার দৃষ্টান্ত টেনে তিনি বলেন, “আদালত অবমাননায় মাহমুদুর রহমানের যদি ছয় মাসের জেল হয়, তাহলে মিজানুর রহমানের ছয় বছর জেল হওয়া উচিত।”

রোকন বলেন, “তিনি বলছেন, জামিন ব্যক্তি স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। কিন্তু গণজামিন একটি দূরারোগ্য ব্যাধি। গণজামিন বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন? এখানে একটা আবেদনে কি ১০০ জন আবেদন করেছে?

“আই থিঙ্ক হি ইজ অ্যাড্রেসিং ক্যান্টনমেন্ট। নয়তো তিনি এ সব কোথা থেকে বলছেন? প্রেস ফ্রিডম থাকার মানে একজনকে ছোট করবেন, এটা তো হতে পারে না।”

দুপুর ১টা পর্য্ন্ত রোকন উদ্দিন মাহমুদ একাই শুনানিতে অংশ নেন।

বিরতির পর শুনানি আবার শুরু হলে অংশ নেন আজমালুল হোসেন কিউসি, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নাল আবেদীন।

দুপুর ২টায় শুনানি শুরু হলে প্রথমেই মিজানুরের আইনজীবী শাহদীন মালিক কাঠগড়ায় তাকে বসতে দেয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলে রাজি হয় আদালত।
এরপর আজমালুল হোসেন কিউসি শুনানিতে মিজানুরের জবাবের জন্য তিনটি প্রশ্ন রাখেন।
তা হলো- “কোন ধরনের তদন্ত করে তিনি এ ধরনের প্রতিবেদন লিখলেন? সূত্র উল্লেখ না করে কার সঙ্গে পরামর্শ করে এ লেখা লিখেছেন? তিনি আইন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানেন কি না এবং জানলে কীভাবে জেনেছেন?”
এরপর শুনানিতে আসেন ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক। তিনি শুরুতেই আদালতের রুল নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাংবাদিকদের সংগঠন বিএফইউজে ও ডিইউজের বিবৃতি আদালতের নজরে আনেন।
অবশ্য এর আগেই আদালত বলেছিল, বিচারাধীন বিষয়ে এ ধরনের বিবৃতি কিভাবে প্রকাশ করা যায়?
মিজানুর লিখেছেন, “প্রকৃতপক্ষে জামিন পুলিশি সিদ্ধান্তের বিষয়। আর বাংলাদেশে জামিন নিয়েই হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট ভারাক্রান্ত থাকে।”
রফিক-উল হক এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিচারক তার কাছে জানতে চান, “পুলিশি সিদ্ধান্তের বিষয়, এটা মানে কী? জামিন পুলিশি সিদ্ধান্তের বিষয় হলে কোর্টের দরকার কী?”
ব্যারিস্টার রফিক এসময় বলেন, “ও সব জানে, ওর ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। এক-এগারো থেকেই ও লিখে চলেছে।”
এ সময় উপস্থিত আইনজীবীরা হেসে উঠেন।
বিচারক জানতে চান, মিজানুর তার লেখায় গণজামিন বলতে কি বুঝাতে চেয়েছেন?
উত্তরে রফিক-উল হক বলেন, “গণজামিন আর কোথা থেকে পাবে? গণজাগরণ থেকে পেয়েছে।”
মিজানুর রহমান ২০০৯ সালে একটি আদালতের গোপন একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেখেছেন বলে তার লেখায় উল্লেখ করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে ব্যারিস্টার রফিক বলেন, “ও দেখতে পারে। আমি জানি, ও খুব পাওয়ারফুল লোক। ও দেশের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন।”
সকালের শুনানিতে এ বিষয়ে রোকন উদ্দিন বলেন, “এটাতো গোপনীয় বিষয়। তিনি কিভাবে দেখেন?”
এরপর ব্যারিস্টার রফিক বলেন, “মিজানুর রহমান আদালত অবমাননা করেছেন।
এজন্য ‘প্রতীকী হলেও তার ন্যূনতম শাস্তি’ দাবি করেন রফিক।
একদিনে একটি আদালতে জামিন তালিকায় ৭১৮টি মামলার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মিজানুর রহমান খান।
এ বিষয়ে জয়নাল আবদীন বলেন, “এক লোক হাটবারে বাজারে গিয়ে তার চিন্তা ছিল বাজারের এত মানুষ কোথায় ঘুমাবেন, আর এত বালিশই বা কোথায় পাবেন।”
“কার্যতালিকায় এত আগাম জামিন আসা সাধারণ বিষয়।”
এ সময় বিচারক বলেন, “২০ নম্বর বেঞ্চে ৭১৮টি মামলা তালিকায় দেখে উনি অবাক হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ওই দিনই আরেকটি বেঞ্চে ৯৫১টি মামলা তালিকায় ছিল। উনি তো ওটা দেখে ‘অবাক’ হননি।”
এরপর আবারো শুনানিতে অংশ নেন রোকনউদ্দিন মাহমুদ।
শুনানি শেষ করার আগে তিনি বলেন, “তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেই পেতে পারেন না। আর নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করলেই ক্ষমা করতে হবে এমন কোনো চিরন্তন বিধি নেই।
“উনি প্রথম সুযোগে ক্ষমা প্রার্থনা করেন নাই। উনার লেখায় ক্ষতি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। তাই ওনাকে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।”