অতীশ দীপঙ্করকে নতুন করে আবিষ্কারের আশা

মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার নাটেশ্বরে যে বৌদ্ধ মন্দিরের সন্ধান মিলেছে, তা থেকে অতীশ দীপঙ্করের বাল্য ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন গবেষক দল।

ফারহানামির্জাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2014, 06:49 AM
Updated : 1 March 2014, 06:50 AM

এক সময় বিক্রমপুর নামে পরিচিত প্রাচীন এই জনপদে একটি বৌদ্ধ মন্দিরের সন্ধান পেয়েছেন প্রত্নত্ত্বাতাত্ত্বিকরা, শুক্রবার সেই খননকাজ সরেজমিন দেখতে যান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

প্রাচীন এই নিদর্শনের খনন কাজের প্রধান প্রধান ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, নাটেশ্বর গ্রামে খননে ৯ মিটার বাই ৯ মিটার পরিমাপের একটি বৌদ্ধ মন্দির, অষ্টকোণাকৃতি স্তূপ, ইট নির্মিত নালা, আরো বেশ কিছু স্থাপত্যিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।

প্রাচীন বঙ্গ এবং সমতট জনপদের রাজধানী বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনীর গ্রামে জন্ম হয় অতীশ দীপঙ্করের (৯৮০-১০৫৪ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি বৌদ্ধ জগতে দ্বিতীয় বুদ্ধ হিসেবে পূজনীয়।

জগৎবিখ্যাত বিক্রমশীল এবং সোমপুর মহাবিহারের অধ্যক্ষ হিসেবে অতীশ দীপঙ্করের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি তিব্বত পর্যন্ত ছড়িয়েছিল।

কর্মজীবন জানা গেলেও অতীশ দীপঙ্করের বাল্যজীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না।

ইহিতাসের ডিগ্রি নেয়ার পর প্রত্নতত্ত্বে গবেষণা করে এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মুস্তাফিজর রহমান বলেন, “প্রশ্ন জাগে বাল্যজীবনে তিনি (অতীশ দীপঙ্কর) কোথায় বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা-দীক্ষা নেন? বৌদ্ধ ধর্মে তার পাণ্ডিত্যলাভ কি হঠাৎ হয়েছে?”

“আমাদের ধারণা প্রাচীন বিক্রমপুরে সদ্য আবিষ্কৃত বৌদ্ধ বিহারের সঙ্গে অতীশ দীপঙ্করের একটি গভীর সর্ম্পক ছিল,” বলেন তিনি।

বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এই খনন কাজে ৭০ জন কর্মী কাজ করছে। এর মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। ফাউন্ডেশনের সভাপতি রাজনীতিক নূহউল আলম লেনিনও সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছেন।

মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, জরিপ ও খনন কাজ শুরু হওয়ার পর চার বছরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ  প্রত্নস্থান ও প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে।

সাম্প্রতিক আবিষ্কার একটি বৌদ্ধ বিহারের অংশবিশেষকে তাৎপর্যময় বলে উল্লেখ করেন তিনি। সেখানে এ পর্যন্ত ছয়টি ভিক্ষু কক্ষ উন্মোচিত হয়েছে।

বৌদ্ধ মন্দিরটি আনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পশ্চিম-দক্ষিণ কোণা ২ দশমিক ৪০ মিটার উচ্চতায় টিকে আছে। ১ দশমিক ৭৫ মিটার প্রস্তের দেয়ালের ভিত্তিমূলে ঝামা ইট ব্যবহার করা হয়েছে।

অধ্যাপক মুস্তাফিজুর বলেন, “হাতে কাটা ইটের অপূর্ব জালি নকশা এবং বিভিন্ন আকৃতির ইটের কাজ মন্দিরের অসাধারণ নান্দনিক স্থাপত্যের রূপ দানে সহায়তা করেছে।”

শুক্রবার এই প্রত্নস্থান পরিদর্শনের পর আসাদুজ্জামান নূর সংবাদ সন্মেলনে বলেন, “নাটেশ্বরে আজ আমাদের যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে পেলাম নিঃসন্দেহে এটি আমাদের জাতির ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় সংযোজিত করবে।”

মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বরে খননে বেরিয়ে আসা প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের একাংশ।

নূহউল আলম লেনিন বলেন, “বিক্রপুরের সমৃদ্ধ ইতিহাস থেকেই আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি সভ্যতার অনেক নিদর্শন মাটিচাপা রয়েছে। কিন্তু বিগত একশ’ বছরেও এগুলো উদ্ধারে এখানে খনন বা কার্যকরী কোন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি। তাই আমরা উদ্যোগী হয়ে ২০১১ সাল থেকে প্রথমে জরিপ করি।”

২০১১ সালে খনন শুরু করে ২০১৩ সালের ২৩ মার্চ আবিষ্কৃত হয় রঘুনাথপুরে বিক্রমপুর বৌদ্ধ বিহার। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে টঙ্গীবাড়ি উপজেলার নাটেশ্বরে খনন শুরু হয়।

সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, অনুমিত হয় প্রায় ৭ একর এলাকাজুড়ে যে দেউল (উচু ভূমি) রয়েছে সবখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রাচীন নানা স্থাপত্য । খনন সম্পূর্ণ হলে স্থাপত্যগুলোর চেহেরা স্পষ্ট হবে।

যে ভূমিতে এই বৌদ্ধমন্দির ও অন্যান্য স্থাপত্য নির্দশন আবিষ্কৃত হয়েছে তার প্রায় ২ একর জমির তদারকি করতেন প্রবীন শিক্ষক নরেশ চন্দ্র দাস ও নারায়ণ চন্দ্র দাস। জমিগুলো অর্পিত হলেও স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে লিজ নিয়ে এই শিক্ষকই ভোগ দখল করতেন।

নরেশ চন্দ্র দাস বলেন, মূলবান জমি গেলেও তিনি সন্তুষ্ট যে বিক্রমপুরের প্রাচীন এই সভ্যতা ফুটে উঠেছে।

নাটেশ্বরের বাসিন্দা নসরউদ্দিন নসু মাদবর বলেন, “খনন কাজের জন্য আমাদের জমিজমা কিছু ক্ষতি হলেও আমরা খুশি। কারণ এখানে যে এত মহামূল্যবান সম্পদ লুকিয়ে ছিল তা উদ্ধার হচ্ছে এটাই বড়প্রাপ্তির কথা।”