‘মুরিদ সেজে ঢুকে ১০-১২ জন মিলে হত্যা’

গোপীবাগে ছয় খুনের মামলায় কেউ গ্রেপ্তার না হলেও পুলিশ ও পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, মুরিদ সেজে বাসায় ঢুকে ১০ থেকে ১২ জন মিলে কথিত পীর লুৎফর রহমানসহ (৬০) ছয়জনকে হত্যা করে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Dec 2013, 11:58 AM
Updated : 22 Dec 2013, 03:26 PM

পুলিশের ধারণা, ধর্মীয় আদর্শগত বিরোধ অথবা পুরনো শত্রুতা থেকেই এ হত্যাকাণ্ড। পরিবারের সদস্য ও অনুসারীরাও জঙ্গিবাদী ও উগ্রপন্থীদের দিকে আঙুল তুলেছেন। 

শনিবার সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ৬৪/৬ নম্বরে চার তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।

নিহতরা হলেন- লুৎফর রহমান ফারুক (৬০), যিনি নিজেকে পীর বলে পরিচয় দিতেন; তার ছেলে সারোয়ার ইসলাম  ফারুক ওরফে মনির (৩০);  পীরের খাদেম মঞ্জুর আলম মঞ্জু (২৪); মুরিদ মো. শাহিন (২৫), রাসেল (২০) ও মুজিবুল সরকার  (২৫)।

তাদের লাশ মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।

এ ঘটনায় গভীর রাতে ওয়ারী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন লুৎফরের ছোট ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক।

ওয়ারী থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা জানান, মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে।

গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, লুৎফর রহমানকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে ২০১১ সালের ১৩ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ‘হিযবুল মাহাদী’ নামে নিজের ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচারের জন্য তার একটি সংগঠনও ছিল।

“হত্যার আলামত দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, এটি অত্যন্ত পরিকল্পিত হত্যা, যাতে অন্তত ১০/১২ জন অংশ নিয়েছে।”

খুনিরা চলে যাবার সময় একজনের নামও বলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, কাউকে ফাঁসাতে তারা ওই নাম বলেছে কিনা- তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

মনিরুল ইসলামের ধারণা, পূর্ব শত্রুতা, জমির বিরোধ বা ধর্মীয় মতাদর্শ নিয়ে বিরোধের জেরেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, লুৎফর কখনো নিজেকে ইমাম মাহাদী, আবার কখনো তার প্রধান সেনাপতি বলে দাবি করতেন। তিনি ও তার অনুসারীরা ধর্ম পালন করতেন ‘নিজস্ব নিয়মে’।

ওই বাসা থেকে ‘কিছু জিনিস’ খোয়া গেলেও এ ঘটনাকে ডাকাতি বলে মনে করছে না পুলিশ।

ঘটনার পর ওই বাড়ির আশেপাশের এলাকা থেকে ছয় জনকে আটক করা হলেও জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলেও জানান ওয়ারীর ওসি তপন চন্দ্র সাহা জানান।

লুৎফরের বাড়ি টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের চর বরুরি গ্রামে। তার ছেলে সারোয়ার ইসলাম সিটি ব্যাংকের সদরঘাট শাখায় কর্মরত ছিলেন বলে তার স্বজনরা জানিয়েছেন।

 

নিহত সারোয়ার ইসলামের স্ত্রী ফেরদৌসী তালুকদার বিথি জানান, শনিবার সন্ধ্যার পর তাদের বাসায় কয়েকজন ‘মুরিদ’ আসে। ঘটনা যখন ঘটে, তখন তিনি ছিলেন রান্নাঘরে।

“হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন আমাকে জোরে চড় মারে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুখে টেপ পেঁচিয়ে আমাকে টেনে হিঁচড়ে আরেক ঘরে নিয়ে যায়।”

এ সময় একটি কক্ষে শ্বশুর লুৎফর রহমান ও স্বামী সারোয়ার ইসলামকেও হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেন বিথি।

“আমার ধারণা, মুরিদ সেজেই আমার শ্বশুর ও স্বামীসহ বাকিদের হত্যা করা হয়েছে।”

এরপর লুৎফরের স্ত্রী, ছেলের বউ ও দুই শিশুসহ সাতজনকে পাশের কক্ষে নিয়ে হাত-পা বেঁধে ও মুখে টেপ লাগিয়ে তালা লাগিয়ে দেয় খুনিরা। জবাই করে হত্যা করা হয় বাকি ছয়জনকে। 

পাশের ভবনের দোতলার বাসিন্দা মফিজ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, হঠাৎ চিৎকার শুনে তিনি দৌড়ে গিয়ে দরজার সামনে লাশ পড়ে থাকতে দেখেন।

পরে পুলিশ এসে বাসার একটি কক্ষ থেকে দুটি এবং অন্য কক্ষ থেকে চারটি লাশ পায়। সবার হাত-পা বাঁধা এবং মুখে টেপ লাগানো ছিল।

লুৎফরের অনুসারী যাত্রাবাড়ির কাঁচামাল ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে এই ‘পীরের’ মুরিদ।

“তার লেখা বই পড়িই আমি আকৃষ্ট হই। তার মতাদর্শ প্রচার করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমাদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে।”

আজিজুর রহমান জানান, ‘পীর সাহেব’ এর আগে গেন্ডারিয়া সাধনা ওষুধের গলি, যাত্রাবাড়ির বিবির বাগিচা ও গোপীবাগের প্রথম লেনেও ভাড়া থাকতেন। সেসব বাসায় ‘বিরোধী মতাদর্শের লোকজন’ কয়েক দফা হামলার চেষ্টা করে।

“২০০৭ সালে পীর সাহেবের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়ে আমাকে ৪ মাস ১৯ দিন কারাগারে থাকতে হয়েছিল।”

লুৎফরের ছোট ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক বলছেন, তার বাবা নিজেকে ইমাম মাহাদীর সেনাপতি বলতেন। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে ‘জঙ্গিগোষ্ঠী’ তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।

তারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে আবদুল্লাহ আল ফারুকের ধারণা। 

নিহত রাসেলের (২০) বেয়াই আবদুল আলীম মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে সাংবাদিকদের জানান, রাসেল উত্তরার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন। তার বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায়।

নিহত মজিবুর সরকারের (২৫) বাড়ি গাজীপুর সদরের বড়ইকান্দি গ্রামে। আর লুৎফরের খাদেম কেয়ারটেকার মঞ্জুর আলমের (২৪) বাড়ি সিরাজগঞ্জের ব্রাহ্মণগাতি গ্রামে।