লাখো কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’

বেয়াল্লিশ বছর আগে যে মুহূর্তে যে স্থানটিতে বাঙালির মুক্তির সনদ লেখা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সেই ক্ষণে সেই স্বাধীনতা উদ্যানেই লাখো কণ্ঠ গাইল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2013, 11:01 AM
Updated : 16 Dec 2013, 05:17 PM

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটিই একাত্তরের রণাঙ্গনে বাঙালি জাতিকে প্রেরণা যুগিয়েছিল, যা পরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহণ করা হয়।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত ‘বিজয় ২০১৩’ মঞ্চে সোমবার বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে এই গানে কণ্ঠ মেলান সমবেত জনতা।

আর তারপর যুদ্ধাপরাধী ও  তাদের সহযোগীদের বর্জনের শপথ নেন তারা। শপথ করার ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সাক্ষী মুক্তিবাহিনীর উপঅধিনায়ক এ কে খন্দকার।

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রথম ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডের পর এবার বিজয় দিবস উদযাপনে মেজাজ ছিল ভিন্নতর; কেন ভিন্ন তা ফুটে উঠে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কথায়।

“আমরা ৪০ বছর ধরে দাবি করে আসছি, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের বিচার হোক। অবশেষে সেই বিচারের প্রক্রিয়া চলছে এবং প্রথম রায় কার্যকর হয়েছে।”

“এদেশে ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়ার একটা চেষ্টা সব সময় চলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি এর অনেকটাই অবসান হয়েছে। যে ইতিহাস আমাদেরকে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে, সেই ইতিহাস সম্পর্কে সম্পুর্ণ সচেতন হয়ে এক নতুন যাত্রা শুরু করেছি।”

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই উৎসবে এবার সম্মিলিত আয়োজক ছিল বিজয় ২০১৩ উদযাপন জাতীয় কমিটি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি, বিজয় ৪:৩১ মঞ্চ ও গণজাগরণ মঞ্চ।

মঞ্চে সকাল থেকেই একাত্তরে মুক্তিকামী মানুষকে শক্তি যোগানো বিভিন্ন গানসহ নানা অনুষ্ঠান চলে বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটের কিছু সময় আগ পর্যন্ত।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে পাকিস্তানি বাহিনী এই উদ্যানে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিল, তখন এর নাম ছিল রেস কোর্স ময়দান।

অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার বলেন, “সেই ক্ষণে জাতীয়ভাবে আমাদের প্রাণের জাতীয় সংগীতকে কোটি কণ্ঠে পরিবেশনাই আজকের অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য।”

জাতীয় সংগীত গাওয়ার আগে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আমাদের ছয় দফার অনেকগুলো ইতোমধ্যে পূরণ হয়েছে। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, একজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।

“আমরা মনে করি, আজকে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মাধ্যমে যে অনুপ্রেরণা আমরা ধারণ করব, সেই শক্তিতে আমদের ভবিষ্যতের যে আন্দোলন রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণের যাত্রার প্রেরণা যোগাবে।”

“আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে যাত্রা করব, যে বাংলাদেশের জামায়াত ইসলামীসহ কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তির স্থান থাকবে না।”

ঠিক ৪টা ৩১ মিনিটে সবাই দাঁড়িয়ে যান, সমবেত কণ্ঠে ধরেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি থেকে মূল উদ্যানের ভেতর তখন লোকারণ্য। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন স্থানেও একই সময় জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়।

বিজয় মঞ্চে জাতীয় সংগীতের পর শপথ পাঠ করান মুক্তিযুদ্ধের সমরনায়ক এ কে খন্দকার বীর উত্তম।

শপথে বলা হয়, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অগণিত শহীদ ও বীরের নামে, সকল নির্যাতিত ভাই ও লাঞ্ছিত বোনের নামে আমরা শপথ নিচ্ছি, দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে আমরা শপথ নিচ্ছি, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গড়ে তুলব।

“সেই লক্ষ্যে আমরা নিশ্চিত করব, সকল ধর্ম, জাতিসত্ত্বা আর নারী-পুরুষের সমান অধিকার এবং ন্যায়পরায়ণ সমাজ। সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের পরিপন্থী সকল কাজ ও সব রকম পশ্চাদপন্থা প্রতিরোধ করব।”

“১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং আজো যারা সেই মনোভাব নিয়ে সহিংসতা ও সন্ত্রাস দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আঘাত করে চলেছে, তাদের আমরা পর্যুদস্ত করব।”

যারা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে অপরাধীদের সমর্থন করবে, তাদেরও বর্জন করার শপথ নেন সবাই।

এরপর মুক্তিযুদ্ধের সমরনায়ক ভরাট কণ্ঠে স্লোগান তোলেন ‘জয় বাংলা’, লাখো মানুষ কণ্ঠ মেলায় তার সঙ্গে।

শপথের পর মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী পতাকা তুলে দেন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি মাহমুদুল হক মুন্সীর হাতে। সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ পতাকা তুলে দেন ইমরান এইচ সরকারের হাতে।

এর আগে বিকাল পৌনে ৩টার দিকে বিজয় মঞ্চে শুরু হয় ‘কনসার্ট ফর ফ্রিডম’, যাকে ১৯৭১ এর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর সঙ্গে তুলনা করছেন আয়োজকরা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের দুর্গত মানুষের সাহায্যের জন্য ১৯৭১ সালে ১ অগাস্ট নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন গার্ডেন স্কয়ারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেন বিখ্যাত সেতারবাদক ওস্তাদ রবি শঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসন।

জাতীয় সংগীত ও শপথের পর আতশবাজি প্রদর্শনী হয়, এরপর শুরু হয় কনসার্ট ফর ফ্রিডমের দ্বিতীয় পর্ব। এতে গান গেয়ে শোনায় ব্যান্ড দল মেকানিকস, স্লোগান, ব্ল্যাক, পেন্টাগন, ডি এলিনিমেশন, নেমেসিস, ক্রিপ্টিক ফিট, উচ্চারণ, শূন্য, দলছুট, ওয়ারফেজ ও সোলস।

এই প্রথম পর্বে ব্যান্ড দল ওল্ড স্কুল, রেডিও অ্যাকটিভ, দৃক ও গানের দল ‘জাগরণ’ সঙ্গীত পরিবেশন করেছে। গানের মাঝে মাঝে চলছে আবৃত্তি ও স্লোগান।

সকালে উৎসব শুরু হয় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে। এরপর মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিরবতা পালন করা হয়। পরে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন একে খন্দকার ।

বিকাল পৌনে ৪টা থেকে ৪টা ১০ মিনিট পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এরপর বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

যুদ্ধাপরাধের বাকি মামলাগুলোরও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, “একাত্তরে যারা পীড়িত হয়েছে, পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজনকে হারিয়েছে, বিচারের মাধ্যমে তারা যেন ন্যূনতম সান্ত্বনা পায়।”

“বিজয় দিবসে আমরা জাতির ঐক্য কামনা করি। ১৯৭১ সালে আমরা যেভাবে এক হয়েছিলাম, আজও সেভাবে এক হতে পারব বলে আমরা আশা করি।”

এরপর সোয়া ৪টায় অভিনীত হয় ১৯৭১-এর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক ঘটনা। তারপরই লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত হয়।