একাত্তরে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, ষড়যন্ত্র, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ছয়টি ঘটনায় চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
এর পরপরই সারাদেশে কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়; ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়ার সুযোগ পায় রাষ্ট্রপক্ষ।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ যে রায় ঘোষণা করে, তাতে ষষ্ঠ অভিযোগে কাদের মোল্লাকে দেয়া হয় প্রাণদণ্ড।
একাত্তরের ২৬ মার্চ জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে দর্জি হযরত আলী লস্করের বাসায় যান। সেখানে কাদের মোল্লার নির্দেশে লস্করের স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা করা হয়। এক মেয়ে হন ধর্ষণের শিকার।
ওইদিন ধর্ষেণের শিকার হন হযরত আলী লস্করের মেয়ে মোমেনা বেগম, চার দশক পর এ মামলার তিন নম্বর সাক্ষী হিসাবে ট্রাইব্যুনালের কাছে সেই রতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি।
তার সেই জবানবন্দির ভিত্তিতেই কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দেয় আপিল বিভাগ।
নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে গত বছরের ১৭ জুলাই দেয়া মোমেনার ওই সাক্ষ্য বিচার চলাকালে প্রকাশ করা হয়নি। আপিল বিভাগে রায়ের পর সেই সাক্ষ্য গণমাধ্যমে আসে।
মোমেনা জানিয়েছিলেন, তার বাবা হযরত আলী স্বাধীনতার আগের সেই উত্তাল দিনগুলোতে নিয়মিত আওয়ামী লীগের মিছিলে যেতেন। সত্তরের নির্বাচনের সময় বিহারীদের আবাস মিরপুরে নিজে হাতে ‘নৌকা’ মার্কার পোস্টারও লাগিয়েছেন তিনি।
এ কারণেই কাদের মোল্লা ও তার অবাঙ্গালি সহযোগীদের আক্রোশের শিকার হন হযরত আলী ও তার পরিবার।
স্ত্রী, চার মেয়ে, এক ছেলেকে নিয়ে হযরত আলী থাকতেন মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের কালাপানি এলাকার পাঁচ নম্বর লেইনের ২১ নম্বর বাড়িতে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি নিধন শুরু করলে পরদিনটি ওই বাড়িতেও ‘নরক’ নেমে আসে।
মোমেনার ভাষ্য, বেলা ডোবার আগে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে হামলা হয় তাদের বাড়িতে।
“আব্বা দৌঁড়াইয়া দৌঁড়াইয়া আসে এবং বলতে থাকে- কাদের মোল্লা মেরে ফেলবে। আক্তার গুণ্ডা, বিহারীরা আর পাক বাহিনীরা দৌঁড়াইয়া আসছিল। আব্বা ঘরে এসে দরজার খিল লাগায়ে দেয়।”
হযরত আলী লস্করের দরজা এঁটে সন্তানদের খাটের নিচে লুকাতে বলেন। মোমেনার সঙ্গে তার বোন আমেনা বেগমও খাটের নিচে ঢোকেন। এ সময় দরজায় শোনা যায় কাদের মোল্লাসহ বিহারীদের চিৎকার।
“এই হারামি বাচ্চা দরজা খোল, বোম মার দেঙ্গা।”
শুরুতে দরজা না খোলায় বাড়ির দরজার সামনে একটি বোমা ফাটানো হয়। এক পর্যায়ে হযরতের স্ত্রী একটি দা হাতে নিয়ে দরজা খোলেন। সেখানেই ঘাতকের গুলি তাকে বিদ্ধ করে।
“আব্বা তখন আম্মাকে ধরতে যায়। কাদের মোল্লা পেছন থেকে শার্টের কলার টেনে ধরে বলে, ‘এই শুয়ারের বাচ্চা, এখন আর আওয়ামী লীগ করবি না? বঙ্গবন্ধুর সাথে যাবি না? মিছিল করবি না? জয় বাংলা বলবি না?’
“আব্বা হাত জোড় করে বলে, ‘কাদের ভাই, আমাকে ছেড়ে দাও’। আক্তার গুণ্ডাকে বললো, ‘আক্তার ভাই, আমাকে ছেড়ে দাও’।”
সেই আর্তি সেদিন ঘাতকদের কানে যায়নি। হযরত আলীকে টেনে-হিঁচড়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যায় তারা।
এজলাসে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের সামনে দেখা সেই নৃশংসতার বিবরণ দেন মোমেনা।
“দাও দিয়ে আমার মাকে তারা জবাই করে। চাপাতি দিয়ে খোদেজাকে (বোন) জবাই করে। তাসলিমাকেও (বোন) জবাই করে।”
“আমার এক ভাই ছিল বাবু, বয়স ছিল দুই বছর, তাকে আছড়ায়ে মারে। বাবু ‘মা মা’ করে চিৎকার করছিল,” বলতে বলতে অঝোরে কাঁদেন মোমেনা।
বাবুর চিৎকার শুনে খাটের তলায় লুকানো আমেনা চিৎকার দিলে তার অবস্থান জেনে যায় হামলাকারীরা।
এরপর আমেনাকে তারা টেনে বের করে, সব কাপড়-চোপর ছিড়ে ফেলে। চলতে থাকে নির্যাতন। এক সময় আমেনার চিৎকারও থেমে যায়।
কাঁদতে কাঁদতে দিশাহারা মোমেনা এরপর আদালতে দেন নিজের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা।
তখন পর্যন্ত মোমেনা খাটের নিচেই লুকিয়ে ছিলেন। সন্ধ্যা হলে হামলাকারীরা যাওয়ার সময় ঘরের বিভিন্ন জায়গায় খুঁচিয়ে খুচিয়ে দেখে, আর কেউ আছে কিনা।
একটি খোঁচা মোমেনার পায়ে লাগলে মুখ দিয়ে বের হওয়া শব্দ তার অবস্থান জানিয়ে দেয়। এরপর তার ওপরও চলে নির্যাতন, এক সময় সংজ্ঞা হারান তিনি।
রাতে চেতনা ফিরলে কোনো রকমে পাশের ফকির বাড়িতে যান মোমেনা। সেখানে তারা তাকে আশ্রয় দেন। তাদের মাধ্যমে শ্বশুরবাড়িতে খবর পাঠানো হলে মোমেনাকে নিয়ে যান তারা।
স্বাধীনতার পর মিরপুরে লাশ খুঁজতে যেতেন মোমেনা। কিন্তু বাড়িতে কাউকে পাননি। পাননি বাবার খোঁজও।
“কামাল খান নামে একটা লোক ছিল, সে মুক্তিযোদ্ধাদের চা বানিয়ে খাওয়াত। সে আমাকে বলতে, ‘কাদের মোল্লা তোর বাবা-মাকে মেরে ফেলছে’। আক্কাস মোল্লা আমার উকিল বাবা ছিলেন, তিনিও একই কথা বলতেন।”
পরিবারের সবাইকে হারিয়ে প্রায় তিন বছর মোমেনা বেগম মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। পরে চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের আরো পাঁচটি ঘটনায় কাদের মোল্লাকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে আদালত।
পল্লবসহ সাত জনকে হত্যা
একাত্তরে মিরপুর-১১ নম্বরের বি-ব্লকের বাসিন্দা ও মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব স্থানীয় বাঙ্গালি ও অবাঙ্গালিদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন। ১৯৭১ সালের মার্চে ‘স্বাধীনতাবিরোধীরা’ পল্লবকে নবাবপুর থেকে ধরে মিরপুরে কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে যায়।
কাদের মোল্লার নির্দেশে পল্লবকে হাতে দড়ি বেঁধে টেনেহিঁচড়ে মিরপুর-১২ নম্বর থেকে ১ নম্বর সেকশনে শাহ আলী মাজার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে মিরপুর-১ নম্বর থেকে ১২ নম্বর সেকশনে ঈদগাহ মাঠে নেওয়া হয় একইভাবে।
পরে পল্লবকে গাছে ঝুলিয়ে আঙুল কেটে দেওয়া হয়। দুদিন পর গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে।
হত্যার দুদিন পর পল্লবের লাশ মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে কালাপানি ঝিলের পাশে আরও ছয় জনের সঙ্গে মাটি চাপা দেয়া হয়ভ
কবি মেহেরুন্নেসা ও তার মা-ভাইকে হত্যা
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সকাল ১১টায় আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর একটি দল কবি মেহেরুন্নেসার মিরপুরের বাসায় যায়। কাদের মোল্লার নির্দেশে সেখানেই মেহেরুন্নেসাকে জবাই করে তারা।
শরীর থেকে মাথা কেটে রশি দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয় মেহেরুন্নেসার লাশ। জবাই করা হয় কবির দুই ভাই রফিকুল হক বাবলু, শরিফুল হক টুকু এবং তাদের মাকেও।
খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর পালিয়ে আরামবাগে চলে যান মিরপুর ১০ নম্বরের বাসিন্দা খন্দকার আবু তালেব। ২৯ মার্চ তিনি মিরপুরে ফিরে দেখতে পান, সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এরপর আরামবাগে ফেরার জন্য মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে গেলে আব্দুল কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা রশি দিয়ে বেঁধে আবু তালেবকে জল্লাদখানা পাম্প হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে তাকে জবাই করা হয়।
কেরানীগঞ্জের দুই গ্রামে গণহত্যা
১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর সকালে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে কেরানীগঞ্জের খানবাড়ি ও ঘটারচর এলাকার দুটি গ্রামে হামলা করে ৪২ জনকে হত্যা এবং বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া হয়।
আলকদী গ্রামে গণহত্যা
একাত্তরের ২৪ এপ্রিল ফজরের নামাজের সময় পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারে করে তুরাগ নদীর পাড়ে পল্লবীর আলকদী গ্রামের পশ্চিম পাশে নামে। সে সময় কাদের মোল্লার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর প্রায় ৫০ জন সদস্য ও কয়েকজন বিহারী ওই গ্রাম ঘিরে ফেলে।
এরপর নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। ওই অভিযানে ৩৪৪ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়।