মৃত্যু পরোয়ানা জারির কথা জামায়াত নেতাকে জানানো হয়েছে বলে কারা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে তিনি তার আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন।
এদিকে রোববার দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের মৃত্যু পরোয়ানা জারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সোমবার হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী। তাদের দাবি, দলীয় নেতা ‘ষড়যন্ত্রমূলক হত্যাকাণ্ডের’ শিকার হতে চলছেন।
অন্যদিকে একাত্তরে নৃশংসতার জন্য ‘মিরপুরের কসাই’খ্যাত কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারির খবরে সন্তোষ জানিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। শাহবাগে মিছিল থেকে বিজয় দিবসের আগেই দণ্ড কার্যকরের দাবি উঠেছে।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিবন্ধক এ কে এম নাসিরউদ্দিন রোববার বিকালে কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারির তথ্য সাংবাদিকদের জানান।
এরপর লাল কাপড়ে মোড়া পরোয়ানা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে যান ট্রাইব্যুনালের উপনিবন্ধক অরুণাভ চক্রবর্তী।
নাসিরউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের কাছেও অনুলিপি পাঠিয়েছেন তারা। বাকি আনুষ্ঠানিকতা কারা কর্তৃপক্ষ করবে।
নিয়ম অনুযায়ী, কারা কর্তৃপক্ষের প্রথম কাজ কাদের মোল্লার কাছে জানতে চাওয়া- তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবেন কি না।
সেই কাজ করা হয়েছে জানিয়ে কারা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কাদের মোল্লা সময় চেয়েছেন এবং তার আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
কাদের মোল্লার মামলায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগ থেকে রায় প্রকাশিত হওয়ার সাত দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করতে পারেন আসামি। এই সাতদিন গণ্য করতে হবে রায় প্রকাশের পর থেকেই।
জামায়াত নেতাকে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ক্ষমার আবেদন জানাতে হবে। তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করবে কারা কর্তৃপক্ষ।
আপিল বিভাগে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর তৎকালীন আইনমন্ত্রী ও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা শফিক আহমেদ বলেছিলেন, এই ধরনের অপরাধে বিশ্বের কোথাও অপরাধী সাধারণত ক্ষমা পান না।
একাত্তরে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের জন্য কাদের মোল্লাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ফেব্রুয়ারি মাসে যাবজ্জীবন সাজার আদেশ দিলেও পরে আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড হয় তার।
ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সকালে ট্রাইব্যুনালে পৌঁছার পর মৃত্যু পরোয়ানা জারির প্রক্রিয়া শুরু হয়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপিতে ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সদস্য বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও মো. শাহিনুর ইসলাম স্বাক্ষর করেন।
পরে দুই পৃষ্ঠার একটি পরোয়ানা খামে করে এবং লাল কাপড়ে মোড়ানো ৭৯০ পৃষ্ঠার নথিসহ রায়ের কপি নিয়ে কালো রংয়ের একটি প্রাইভেটকারে চড়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পথে বেরিয়ে যান উপনিবন্ধক।
প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের গত ১৭ সেপ্টেম্বর দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিতে বিচারকদের স্বাক্ষরের পর গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়।
এই রায় পর্যালোচনার আবেদন জানানো হবে বলে কাদের মোল্লার প্রধান আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক বলে এলেও প্রসিকিউটরদের বক্তব্য, ট্রাইব্যুনালের বিচারের ক্ষেত্রে আসামির সেই সুযোগ নেই।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ ধারা তুলে ধরছেন প্রসিকিউটররা।
এ ধারা অনুযায়ী, গণহত্যাজনিত অপরাধে দণ্ডিতদের মৌলিক মানবাধিকার পাওয়ার সুযোগ নেই।
ফলে সংবিধানে বর্ণিত সব ধরনের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়।
তবে কাদের মোল্লার আইনজীবী তারিকুল ইসলাম জানান, কারাগারে আসামির সঙ্গে পাঁচ আইনজীবীর সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার বরাবর রোববারই আবেদন করা হয়েছে।
পাঁচ আইনজীবী হলেন- বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, মতিউর রহমান আকন্দ, তাজুল ইসলাম ও শিশির মোহাম্মাদ মুনির।
আবেদনে বলা হয়, আপিল বিভাগের রায় পর্যালোচনার আবেদনের বিষয়ে নির্দেশনার জন্য আব্দুল কাদের মোল্লার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা প্রয়োজন।
কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকরের বিষয়ে কারাফটকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ফরমান আলী বলেন, ‘বিষয়টি ‘আইনানুগ’ হওয়ায় আদালতের আদেশ কার্যকর করার জন্য কবে থেকে গণনা শুরু হবে তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।
কারাবিধি অনুযায়ী আপিল বিভাগ থেকে রায় প্রকাশিত হওয়ার পরে ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে সাজা কার্যকর করার বিধান রয়েছে। তবে কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে কারাবিধি প্রযোজ্য হবে না বলে প্রসিকিউটরদের অভিমত।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের সমন্বয়ক এম কে রহমান বলে আসছেন, কাদের মোল্লার দণ্ড বাস্তবায়নের দিনক্ষণ সরকারের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে।
“আইন অনুসারে সরকারের সিদ্ধান্তে এই রায় বাস্তবায়ন হবে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার চাইলে জেল কোড অনুসরণ করতে পারে।…তবে জেল কোড অনুসরণের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।”
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের দাবি, রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কারাবিধি অনুসরণের বিকল্প নেই।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, দ্রুত এই রায় বাস্তবায়ন করা হবে।
কাদের মোল্লা গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।
সাধারণ মামলায় বিচারিক আদালত কোনো আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিলে দণ্ডাদেশ কার্যকরের জন্য জন্য হাই কোর্টের অনুমোদন লাগে। এক্ষেত্রে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির আপিলের সুযোগও রয়েছে।
তবে আপিল না করলেও ওই দণ্ড কার্যকরে হাই কোর্টের অনুমোদন লাগে। হাই কোর্টে নিষ্পত্তির পর আসামি আপিল বিভাগে লিভ পিটিশন দায়ের করতে পারেন।
তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনালই হাই কোর্টের সমমর্যাদা সম্পন্ন। ওই আইন অনুসারে ট্রাইব্যুনালের যে কোনো দণ্ডের বিরুদ্ধে উভয় পক্ষ আপিল বিভাগে সরাসরি আপিল করতে পারেন।
সাধারণ ক্ষেত্রে আপিল বিভাগে আবেদন না করলে হাই কোর্ট মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে অনুমোদন দেয়ার পর মৃত্যুদণ্ডের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আসামির ক্ষমার আবেদন পাওয়ার পর জেল সুপার তা স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে পাঠাবেন। সঙ্গে পৃথক পত্রে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সম্ভাব্য তারিখ এবং আসামির দণ্ডের বিষয়ও থাকবে।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে ওই রায়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেয় শাহবাগের আন্দোলন, যা বহির্বিশ্বে ‘বাংলা বসন্ত’ নামে পরিচিতি পায়।
দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন করে দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের ক্ষেত্রে আসামি ও প্রসিকিউশন উভয় পক্ষের সমান সুযোগ আনা হয়।
সংশোধিত আইনের বলে প্রসিকিউশনের আপিলে ছয় নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বদলে আপিল বিভাগ দেয় সর্বোচ্চ সাজার আদেশ।
এই অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২৬ মার্চ কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে হযরত আলী লস্করের বাসায় যান। সেখানে কাদের মোল্লার নির্দেশে লস্করের স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা করা হয়। এক মেয়ে হন ধর্ষণের শিকার।
৭৯০ পৃষ্ঠার রায়ে বলা হয়, ষষ্ঠ অভিযোগে ৪:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। মৃত্যু পর্যন্ত তাকে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।