ফেইসবুকে হয়রানি: ‘অসহায়’ নিয়ন্ত্রক সংস্থা

ইন্টারনেটে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে আপত্তিকর ছবি, ভিডিওসহ বিদ্বেষমূলক তথ্য ছড়ানো চললেও তা বন্ধে কার্যকর কোনো পথ পাচ্ছে না টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

মামুনুর রশীদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2013, 12:59 PM
Updated : 1 Nov 2013, 01:11 PM

বিটিআরসি কর্মকর্তারা বলছেন, ফেইসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময় ‘যথাযথ সাড়া’ দেয় না বলে তারাও খুব বেশি কিছু করতে পারছেন না।  

অথচ ইন্টারনেটে হয়রানির কারণে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বড় ধরনের সংকটে পড়তে হচ্ছে বহু নারীকে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক ছাত্রী তার বিয়ের কয়েক দিনের মাথায় জানতে পারেন- তার নাম ও ছবি দিয়ে করা একটি ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে বিভিন্ন আপত্তিকর তথ্য ও ছবি ছড়ানো হচ্ছে। এক পর‌্যায়ে বিষয়টি তার শ্বশুরবাড়ীর লোকজনের নজরে পড়লে তাকে চরম হেনস্থার শিকার হতে হয়।

অথচ নিজের কোনো ফেইসবুক অ্যাকাউন্টই ছিল না বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান ওই শিক্ষার্থী।

তার ধারণা, প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় কেউ তার নাম ও ছবি ব্যবহার করে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে এ কাজ করেছে।

বিষয়টি পরিবারের কাছে খুলে বলার পরও গঞ্জনা থেকে রেহাই মেলেনি মেয়েটির। এক পর‌্যায়ে আত্মহত্যারও চেষ্টা চালান তিনি।

কিছুদিন আগে একটি পর্নো সাইটে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এক নারী কর্মকর্তার ছবি ও ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর তুলে দেয় কোনো একজন। এরপর শুরু হয় একের পর এক কল। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত পারিবারিক কলহে গড়ায়।

সাইবার জগতে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোতে নারীদের হয়রানির ঘটনা যে ক্রমশ বাড়ছে-বিটিআরসি গঠিত বাংলাদেশ  কম্পিউটার সিকিউরিটি ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিমের (বিডি-সিএসআইআরটি) কাছে জড়ো হওয়া বিপুল সংখ্যক অভিযোগই তার প্রমাণ।

বিডি-সিএসআইআরটিএর আহ্বায়ক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তাদের কাছে গত দেড় বছরে দুই হাজারের মতো অভিযোগ এসেছে, যার প্রায় ৭০ শতাংশই  ফেইসবুক ও বিভিন্ন পর্নো ওয়েবসাইটকে কেন্দ্র করে।

আর অভিযোগকারীদের অধিকাংশই ছাত্রী ও পেশাজীবী নারী।

পাশাপাশি ফেইসবুকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ ছড়ানো, ইউটিউবে আপত্তিকর ভিডিওচিত্র তোলা, ই-মেইলের মাধ্যমে হুমকি এবং ওয়েবসাইট হ্যাক করাও অভিযোগও পেয়েছে বিডি-সিএসআইআরটি।

র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক হাবিবুর রহমানও জানান, নারীরাই এ ধরনের হেনস্তায় বেশি পড়ছেন।

বিটিআরসির একজন সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ বিডিনিউজ টোয়েণ্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইউটিউব ও ভিডিও শেয়ারিং সাইটগুলোর বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অভিযোগ আসছে।

“এসব ক্ষেত্রে সাইটগুলোকে সেসব ভিডিও সরিয়ে ফেলার অনুরোধ করা হয়। যারা তাতে সাড়া দেয় না, তাদের ওয়েবসাইট বাংলাদেশে না দেখার ব্যবস্থা করা হয়।”

সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে গত বছরের ২৫ জানুয়ারি বিডি-সিএসআইআরটি সেল গঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৩১৭টি ওয়েবসাইট এভাবে ‘ব্লক’ করা হয়েছে বলে ওই সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ জানান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এগুলোর মধ্যে ২২২টিই বিভিন্ন পর্নো সাইট। বাকিগুলোর মধ্যে ৬০টি রাজনৈতিক বিদ্বেষ ছড়ায় এমন সাইট এবং ৩৫টি সাইটের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে রয়েছে।”

এসব ওয়েবসাইট বন্ধ করা গেলেও ফেইসবুকের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।

তিনি বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় অভিযোগকারীর  নিজস্ব  ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থাকলে তার পরিচয়পত্র (ফটো আইডি)  ফেইসবুক কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হতো।  আর যাদের ফেইসবুক অ্যাকাউন্টই নেই তারা থানায় জিডি করার পর তার অনুলিপি  ফেইসবুক কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হয়। কিন্তু তাতে ফেইসবুক কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।

এই পরিস্থিতিতে বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারস্থ হয়।

“তাদের মাধ্যমে অভিযোগ পাঠানো হলে সামাজিক-রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অভিযোগের সুরাহা হলেও নারীর যৌন হয়রানির বিষয়গুলোতে তেমন ফল আসেনি।”

কারণ হিসাবে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, “ধরা যাক, যেসব ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে আপত্তিকর ছবি ও বার্তা ছড়ানো হচ্ছে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হলো। কিন্তু দেখা যায় আরেকটি অ্যাকাউন্ট খুলে সেখান থেকে একই কাজ করা হচ্ছে।

“আর সত্যিকারের অ্যাকাউন্টধারীদের অনেক কনটেন্টই ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ আপত্তিকর মনে করে না। কিন্তু সেগুলো আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক দিক থেকে হয়তো আপত্তিকর।”

যৌন হয়রানির বিষয়ে পাঠানো অভিযোগগুলোর মধ্যে এখন পর‌্যন্ত মাত্র একটি ক্ষেত্রে ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান তিনি।

“গত ৩ মে অভিযোগটি পাঠানোর পর ৯ মে ফেইসবুক থেকে ফিডব্যাক আসে। একজন নারীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফেইসবুক থেকে তার কিছু আপত্তিকর ছবি সরিয়ে ফেলা হয়।”

ফেইসবুকে যৌন হয়রানির বিষয়টি স্পষ্টতই ‘সাইবার অপরাধ’ হলেও বাংলাদেশের আইনি কাঠামোর জটিলতায় ফেইসবুক কর্তৃপক্ষকে চাপ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছেন এই বিশেষজ্ঞ।   

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, সাইবার অপরাধের বিষয়টি ‘আইসিটি অ্যাক্ট’ এর আওতায় পড়ে। টেলিকম আইনে বিষয়টির কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু বিটিআরসি চলে টেলিকম আইনে। ফলে বিটিআরসির ডাকে সাড়া দেয়ার যথেষ্ট আইনি বাধ্যবাধকতা নেই বলে ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ মনে করতে পারে।     

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি ডিভিশনের হেড অব প্রোগ্রাম সুমন আহসান ইন্টারনেটে ‘যৌন হয়রানির’ বিষয়টিকে দেখছেন ‘নতুন সামাজিক অবক্ষয়’ হিসাবে।

তার মতে, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শিক্ষার হার এবং মনোসামজিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে ‘ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার’ ও টেলিকম কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এর অপব্যবহার সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে হবে।

“এসব কোম্পানি তাদের পণ্যের প্রচারের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। ফলে এর অপব্যবহার সম্পর্কিত প্রচারের বিষয়টিও যথাযথ গুরুত্বের দাবি রাখে। এটা তাদের নৈতিক দায়িত্বও বটে।”

নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের অপব্যবহারের বিষয়ে ‘সার্বক্ষণিক নজরদার’ এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেন তিনি।

স্কয়ার হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শারমিন হক বলেন, “যারা এভাবে অন্যকে হয়রানিতে জড়িত, তারা ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এটা করে। একজন নারীর ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক জীবনে এর প্রভাব কতোটা ভয়াবহ হতে পারে- তা নিয়ে ভাবে না।”

বাংলাদেশে ২০১০ সালের ২৯ মে প্রথমবারের মতো ফেইসবুক ‘ব্লক’ করেছিল সরকার। তবে কয়েকদিন পর তা আবার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।