শুক্রবার রাতে বাংলাদেশ সময় ২টায় শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি তথ্যচিত্র প্রচার করে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন স্টেশনটি।
১৯৭২ সালে হাসিনার পিতা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাতকার নিতে ফ্রস্ট প্রথমবার বাংলাদেশে আসেন।
৪১ বছর পর বাংলাদেশে এসে একই বাড়িতে বসে তিনি সাক্ষাৎকার নেন জাতিরজনকের মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও। এটি তার দ্বিতীয় ও শেষ বাংলাদেশ আগমন।
বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে সর্বসাম্প্রতিক রানা প্লাজা ধস ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে এক পক্ষের সহিংস রাজনীতি নিয়ে ফ্রস্ট কথা বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যার সঙ্গে।
এই বিচার নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করলে সামনে এগোনো যাবে না। যারা তাদের পরিবার-পরিজন হারিয়েছেন, বিচার পাওয়া তাদের অধিকার।”
ডেভিড ফ্রস্ট ইন্টারভিউ নামের অনুষ্ঠানটি শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় পুনঃপ্রচার করা হয়।
এতে বাংলাদেশকে পরিচয় দেয়ার সময় দারিদ্র্য ও সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।এ সময় কয়েক দশক পুরনো রাস্তায় শুয়ে থাকা মানুষ এবং সাম্প্রতিক দায়িত্বরত র্যাব-সদস্যের ছবিও ভেসে উঠে।
তখনকার পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের নানা দিক তুলে ধরেন ভাষ্যকার ফ্রস্ট।
শেখ হাসিনা কথাপ্রসঙ্গে বলেন, শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালে ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এবং তারপর থেকে বহুবার তাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুনেত্রীর ভুমিকার সমালোচনার কথা ধরে এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা স্মিত হেসে বলেন, “পুরুষরা ঈর্ষাপরায়ণ।”
“ক্ষমতাসীন নারীদের প্রতি তাদের এমন মনোভাব?”- ফ্রস্টেরে এই প্রশ্নের জবাব হাসিনা মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলেন।
তথ্যচিত্রে শেখ হাসিনা কেন্দ্রে থাকলেও পার্শ্ব মন্তব্যকারী হিসেবে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ওরফে আসিফ নজরুল এবং সজীব ওয়াজেদ জয়কে দেখা যায়।
শহিদুল আলম ও অধ্যাপক হোসেন মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। আসিফ নজরুল যুদ্ধাপরাধের বিচারে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। সজীব ওয়াজেদ জয় বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী শেখ হাসিনার সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করেন।
যদি সাঁকো পেরোতে গিয়ে পড়ে যাই
প্রথম প্রশ্ন ছিল, তিনি (শেখ মুজিব) পিতা হিসেব কঠোর ছিলেন কি? শেখ হাসিনা বলেন, “কঠোর ছিলেন, কিন্তু অত্যন্ত স্নেহশীল।”
১৯৫৪ সালের পরে শেখ মুজিবের কারাবাসের সময়ে শেখ হাসিনা গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর দাদীর শাসনে ছেলেবেলা কাটান।
“দাদী স্কুলে যেতে দিতে চাইতেন না, যদি সাঁকো পেরোতে গিয়ে নদীতে পড়ে যাই”
দল চালানো মায়ের কাছেও শিখেছি
মা বেগম ফজিলাতুন্নেসার প্রসঙ্গে বলেন, “আম্মা কখনো কোনো কিছু নিয়ে নালিশ জানাতেন না।”
“আব্বার অবর্তমানে তিনিই দলের দেখাশোনা করতেন। পার্টি চালানো আব্বার কাছে যেমন শিখেছি তেমনি আম্মার কাছেও শিখেছি।”
এ সময় ইনসার্ট হিসেবে নেতাকর্মীদের সঙ্গে বেগম ফজিলাতুন্নেসার কথা বলার ছবি দেখা যায়।
‘৩০ লাখ’ চরম সত্য
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিরিশ লাখ শহীদের তথ্যের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি ধারণাও করতে পারি না কোন ধরনের লোক এরা যারা সংখ্যা কমাতে চায়!”
“প্রতিটি পরিবারে তারা [পাকিস্তানি সেনা ও তার সহযোগীরা] কাউকে না কাউকে হত্যা করেছে।”
‘বাকশাল একদলীয় শাসন নয়’
যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রচালনায় শেখ মুজিবের চ্যালেঞ্জগুলোর উল্লেখ করা হয় তথ্যচিত্রে।
সেসময় বাকশালের প্রসঙ্গ উঠে আসে। ফ্রস্টের প্রশ্ন, “একদলীয় রাষ্ট্র কি ভালো বুদ্ধি ছিল?”
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “আব্বা যেহেতু দেশের মানুষকে ভালবাসতেন, তিনি চাইছিলেন মানুষজন উন্নত জীবন পাক। সেসময় তিনি ভেবেছিলেন এই সিস্টেম [বাকশাল] চালু করলে দেশের অর্থনীতি খুব দ্রুত মেরামত করা যাবে।”
“এটা একদলীয় [ব্যবস্থা] ছিল না।তিনি চাইতেন জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উন্নয়নে সবাই একসঙ্গে কাজ করুক।”
তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তিন চার বছরের জন্য আমাদের এটা চালিয়ে নিতে হবে’।”
বাকশালের পরে “গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা” বঙ্গবন্ধুর ছিল কিনা ফ্রস্টের এমন প্রশ্নে শেখ হাসিনা প্রথমত প্রশ্নকর্তাকে তার দৃষ্টিকোণ থেকে শুধরে দেন।
“গণতন্ত্র কিন্তু বহাল ছিল।তিনি [বঙ্গবন্ধু] চেয়েছিলেন তিন বছর পরে ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ ফিরিয়ে আনতে।”
‘খালেদার সাথে সাক্ষাৎ প্রীতিকর ছিল’
খালেদা জিয়ার সঙ্গে ব্যক্তিগত রেষারেষি নেই দাবি করতে গিয়ে শেখ হাসিনা ১৯৭৫ এর আগের স্মৃতিচারণ করেন।
“আমার পিতা যখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন তখন জিয়াউর রহমান ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা। অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানে তার [খালেদা জিয়ার] সাথে আমার দেখা হয়েছে।সে সাক্ষাৎগুলো প্রীতিকর ছিল”
বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের পার্থক্য সম্পূর্ণ আদর্শগত বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
অন্যান্য প্রসঙ্গে
৪৭ মিনিটের তথ্যচিত্রটিতে শেখ হাসিনা আরো কয়েকটি প্রসঙ্গে কথা বলেন। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “এটা মালিক-ক্রেতা সবার জন্যই সতর্ক সংকেত। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন “এটা তাদের দোষ।”