বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় এই অভিনেতার। তার বয়স হয়েছিলো ৮২ বছর।
স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মির্জা নাজিমুদ্দিন সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, “রাত প্রায় আড়াইটার দিকে তিনি মারা যান।”
আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেরও নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আবুল কালাম আযাদও।
বর্ষীয়ান এই অভিনেতা অসুস্থতা নিয়ে গত ১৮ অগাস্ট হাসপাতালে ভর্তি হন। এক সপ্তাহ পর চিকিৎসকরা জানান, তেমন বড় কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা কাটিয়ে ওঠেন ওই সপ্তাহেই।
বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষায় তার পিত্তথলীতে পাথর থাকার বিষয়টি সন্দেহ করছিলেন তার তত্ত্বাবধানকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছিলেন, অস্ত্রোপচারের মতো শারীরিক অবস্থা না থাকায় এভাবেই থাকতে হবে তাকে।
বৃহস্পতিবার বিকালে আনোয়ার হোসেনের অবস্থার খোঁজ নিতে স্কয়ার হাসপাতালে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি তার পরিবারের সদস্যদের ১০ লাখ টাকা অনুদানও দেন।
কিন্তু মধ্যরাতেই মৃত্যু হয় এই অভিনেতার, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যাকে বলা হয় ‘মুকুটহীন সম্রাট’
রাতে তার লাশ স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। ভোরে কফিন নিয়ে যাওয়া হয় তার কলাবাগানের বাসায়। চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেকেই এই অভিনেতাকে শেষবারের মতো দেখতে তার বাসায় ছুটে যান ।
শুক্রবার দুপুরে বায়তুল মোকাররম মসজিদে জানাজা শেষে আনোয়ার হোসেনকে নেয়া হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল এফডিসিতে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজার পর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩১ সালে, জামালপুরের সরুলিয়ায়। ১৯৫০ সালে জামালপুর সরকারি স্কুল থেকে এসএসসি এবং পরে আনন্দমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন।
১৯৫৭ সালে আনোয়ার হোসেন চলে আসেন ঢাকায়, বিয়ে করেন নাসিমা খানমকে। তাদের চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে কেবল মেয়েই দেশে আছেন।
অভিনয়ে আনোয়ার হোসেনের হাতেখড়ি স্কুল জীবনেই। চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন ১৯৫৮ সালে, ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে।
ষাটের দশকে যখন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের উত্থান শুরু, তখনই ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করে আনোয়ার হোসেন হয়ে ওঠেন ‘বাংলার চলচ্চিত্রের মুকুটহীন সম্রাট ’। কয়েকশ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সেই সাম্রাজ্য তিনি শাসন করেন প্রায় চার যুগ ধরে।
১৯৭০ সালে খ্যাতিমান পরিচালক জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে আনোয়ার হোসেনকে দর্শক দেখেছে স্বাধীনতাকামী এক সংগ্রামীর ভূমিকায়। সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে গোলাম মোস্তফার কাজে মুগ্ধ ছিলেন আনোয়ার। কাজ করেছেন এ কালের অভিনেতা শাকিব খানের সঙ্গেও।
কয়েক বছর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এই অভিনেতা বলেছিলেন,“সারাজীবন নিজের আনন্দেই কাজ করেছি। আমি ছিলাম পুরোপুরি অভিনেতা। অভিনয় ছাড়া জীবনে আর কিছু করিনি। পড়াশুনা শেষ করে রূপালী জগতে এসে ঢুকি- সেই থেকে অভিনয় ছাড়া আর কিছু করার কথা কখনো মাথায় আসেনি।”
কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), বন্ধন (১৯৬৪), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), রংবাজ (১৯৭৩), ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), রুপালী সৈকতে (১৯৭৭), নয়নমণি (১৯৭৭), নাগর দোলা (১৯৭৮), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), সূর্য সংগ্রামের (১৯৭৯) মতো বহু চলচ্চিত্র আগামী প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে পর্দার এই ‘নবাবের’ কথা।
‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রের জন্য প্রথমবার জাতীয় পুরস্কার পাওয়া আনোয়ার হোসেন পরে আরো দুই বার এ পুরস্কার পান। ২০১০ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা দেয়া হয় এই গুণী শিল্পীকে। বাংলা চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৫ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
দীর্ঘদিনের কর্মস্থল ঘুরে দেখতে গত জুন মাসে এফডিসিতে যান আনোয়ার হোসেন। হুইল চেয়ারে করে পুরো এফডিসি তিনি ঘুরে দেখেন। অর্ধশতকের নানা স্মৃতির ভীড়ে হারিয়ে যেতে যেতে আবেগে ফুঁপিয়ে ওঠেন মাঝেমধ্যেই।
এফডিসির ঝর্ণা স্পটে সেদিন উত্তরসূরীদের পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনাও জানানো হয়। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক এ যুগের চলচ্চিত্রকর্মীদের পক্ষ থেকে দোয়া চাইলে ‘মুকুটহীন সম্রাট’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কেবল বলেন, “দোয়া আছে।”