সম্প্রতি নিহত এক দম্পতির সন্দেহভাজন কিশোরীকন্যা ঐশী রহমানকে নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতার অভিযোগের প্রেক্ষাপটে শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে এই মতের পাশাপাশি পুলিশের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন দুজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
‘সংবাদে ঐশী: পুলিশ ও গণমাধ্যমের আচরণ’ শীর্ষক এই আলোচনায় শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভূমিকারও সমালোচনা করেন আলোচকরা।
রাজধানীর ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, “গণমাধ্যমগুলোতে সবার আগে সংবাদ প্রচারের প্রতিযোগিতা থেকেই খুনের ঘটনায় ঐশীর সম্পৃক্তা নিয়ে রগরগে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে।”
শিশুদের নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও তার প্রকাশ নিয়ে সংবাদকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার ওপর জোর দেন তিনি।
পুলিশের সমালোচনা করে এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, “খুন করার কথা স্বীকার করলেও কেন রিমান্ডে নিতে হবে।”
ঐশীকে রিমান্ডে পাঠানোর দিন ১৮ অগাস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, হত্যাকাণ্ডে মেয়েটির সরাসরি জড়িত হওয়ার প্রমাণ তারা তদন্তে পেয়েছেন।
ঐশী মাদকাসক্ত দাবি করে মনিরুল সেদিন বলেন, “আসলে মেয়েটির অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। সে বখাটে হয়ে গিয়েছিল। এই বখাটেপনা থেকে ফিরিয়ে আনতে তাকে বাসা থেকে বের হতে দিত না তার মা-বাবা। এ কারণেই মায়ের প্রতি বেশি ক্ষোভ ছিলো ঐশীর।”
সাংবাদিক ও শিশু অধিকার কর্মী আফসান চৌধুরী বলেন, “আমরা আইন ভাঙব এটাই যেন আমাদের জাতীয় ধর্ম। আমরা ভাবি, আইন ভাঙলে আমাদের শাস্তি দেবে কে? আমাদের দেশে প্রেস কাউন্সিল আছে কিন্তু আমরা কেউ পাত্তা দিই না।”
তিনি বলেন, “আমরা নিজেরা যদি সিদ্ধান্ত নেই আমরা (সাংবাদিক) কয়েকজন মিলে একটি নীতিমালা তৈরি করব এবং এগুলো মেনে চলব তাহলেই কেবল এ আইনগুলো মেনে চলা সম্ভব।”
সাংবাদিকদের দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “যারা আইন বানায় তাদেরও আমরা শ্রদ্ধা করি না, নীতিমালাও মানি না।”
‘সাংবাদিক ও বিচারকেদর প্রভাবিত হওয়ার কোনো জায়গা নেই’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এদের অন্য মানুষ থেকে আলাদা থাকা দরকার।”
গণমাধ্যম প্রভাবিত হয়ে পড়লে কখনোই সঠিক তথ্য দিতে পারে না বলেও মতপ্রকাশ করেন প্রবীণ এই সাংবাদিক।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউএম হাবিবুন নিসা শিশুদের নিয়ে তার দেড় দশকের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, “আমরা শিশু ও বড়দের বিচারের পদ্ধতি এক করে ফেলেছি। কাউকে দোষী করার আগে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতার বিষয় রয়েছে। কিন্তু আমরা সত্যকে শ্রদ্ধা করি না।
“একটা মানুষকে বিচারের আগেই এক্সপোজড করে ফেললাম এটা মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে বড় অপরাধ।
সন্দেহভাজনদের টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন আয়োজনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “দাগী খুনিকেও কি ক্যামেরার সামনে এক্সপোজ করতে পারেন? রাষ্ট্রের দায়িত্ব পানিশমেন্ট দেয়া নয়, কারেকশন (সংশোধন) করা। শাস্তি দিয়ে সুখ ভোগ করার জন্য না। এগুলো দিয়ে আমরা প্রতিহিংসার বীজ বপণ করছি।”
মনোরোগ পরামর্শক ফরিদা আক্তার কিশোরী ঐশীর জীবন পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরের কথা উল্লেখ করে বলেন, “ড্রাগ নেয়ার আগে একটা অবস্থান থাকে, সে কোনো কিছুকেই মানে না, সময় মতো কিছুই করে না। এসব দেখে অভিভাবকদের সাবধান হওয়া উচিৎ।
“বর্তমান অবস্থায় এই কিশোরীর চিকিৎসা লাগবে কিনা, কাউন্সেলিং দরকার কিনা- তা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের”, মত দেন তিনি।
শিশুদের বড় করার ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাংসদ বেবী মওদুদ বলেন, “ছোটবেলা থেকেই শিশুদের বইপড়া ও গান শোনার ব্যবস্থা করা উচিৎ।”
ঐশী ও তাদের শিশু গৃহকর্মীকে রিমান্ডে নিয়ে শিশু অধিকার আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে দাবি করে তাদের নিয়ে খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন ইউনিসেফের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ শাকিল ফয়জুল্লা।
তিনি বলেন, “গণমাধ্যমের কোনো ওয়াচডগ নেই। সব মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেন কাউন্সিল থাকবে না?”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে আয়োজিত এ আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আরো ছিলেন সাংসদ ও আইনজীবী ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল এক্সেল একাডেমীর ভাইস প্রিন্সিপাল সেবা তাসমিন হক এবং হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের শিশু সাংবাদিক সামিন ইয়াসার প্রিয়ম।
দুই ঘণ্টার এই বৈঠকের সঞ্চালনায় ছিলেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু।
পটভূমি
গত ১৬ অগাস্ট ঢাকার চামেলীবাগের একটি বাসা থকে পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দুই সন্তান ঐশী ও ঐহী এবং শিশু গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন তারা।
হত্যাকাণ্ডের পর অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ‘ও’ লেভেলের ছাত্রী ঐশী একদিন আত্মগোপনে থাকলেও পরে নিজেই পল্টন থানার আত্মসমর্পণ করে।
পরে ঐশীর চাচা মশিউর রহমানের দায়ের করা মামলায় এই কিশোরীকে পাঁচ দিনের হেফাজতে পাঠায় আদালত, যার বয়স নিয়ে বিতর্ক আছে।
‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ ঐশীকে রিমান্ডে নেয়ার সমালোচনা করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানও।
অভিযোগ উঠেছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক ঐশী ও গৃহকর্মী সুমিকে রিমান্ডে পাঠানোয় শিশু অধিকার আইন লঙ্ঘন হয়েছে। কারো নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সূত্রের কথা বলে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম ঐশীকে জড়িয়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।
স্কুলের নথি অনুযায়ী তার বয়স ১৮ বছর হয়নি। তবে থানায় তার বয়স ১৮ বছর উল্লেখ করা হয়েছে।
ঐশী রহমান অপ্রাপ্তবয়স্ক কি না, তা জানতে ইতোমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে পরীক্ষা করেছেন।