ঘৃণার জুতার মুখে গোলাম আযম

১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি দুপুর, বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে। ফিলিস্তিনে নিহত দুই বাংলাদেশির জানাজা মাত্র শেষ হয়েছে। জানাজায় অংশ নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রধান নেতা গোলাম আযম।

রিয়াজুল বাশারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2013, 08:08 PM
Updated : 14 July 2013, 11:20 PM

এমন সময় তার দিকে এগিয়ে এলেন ৩৬ বছরের এক যুবক। ডান হাতে ধরা পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে পরপর দুটি আঘাত করলেন গোলাম আজমের মুখে। প্রথমটি লাগলো কপালে, দ্বিতীয়টি চোয়ালে।

এরপর ৩২ বছর ধরে এই জুতাপেটার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের প্রতীক হয়ে আছে। 

আর ওই জুতাপেটার ঘটনাটি নিয়ে কয়েকদিন ধরে সংবাদপত্রে খবর ছিল বলে জানিয়েছেন তখনকার তরুণ সাংবাদিক, বর্তমানে দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান।

প্রত্যক্ষদর্শী একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন সেদিনের জুতাপেটার ঘটনাটি। 

গোলাম আযমকে জুতাপেটার সেই ছবি

“দুপুর ১১টা থেকে ১২টার মধ্যকার ঘটনা। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইট তখনো হয়নি। মসজিদের সিঁড়ির কয়েক গজ দূরে লাশ রেখে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।”

“জানাজায় ছাত্র-শিক্ষক-জনতা-বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। জানাজার কিছুক্ষণ আগেই দুটি কার এসে থামে রাস্তার পাশ ঘেঁষে। একটির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসেন গোলাম আযম।”

স্বাধীনতার ঠিক আগে দেশ ছেড়ে যাওয়া গোলাম আযম ১৯৭৮ সালে ফিরলেও দলীয় অনুষ্ঠানের বাইরে সেটাই ছিল তার প্রকাশ্য কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান।

সাংবাদিক মুনীরুজ্জামান বলেন, “জিয়াউর রহমান গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর ওইটাই ছিল তার প্রথম পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্স। মানুষ তাকে কীভাবে নেয়, তার একটা টেস্ট কেইসও ছিল ওই দিন।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ঘটনার বর্ণনাকারী ওই ব্যক্তি নিজেও গোলাম আযমকে জুতাপেটা করেছিলেন।

তার ভাষায়, “গোলাম আযম আসার পরই আমাদের মধ্যে একটা গুঞ্জন তৈরি হলো। তার আসাটা আমরা মেনে নিতে পারিনি।”

“বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা একজন মানুষ এভাবে আমাদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে জানাজা পড়বে, আমাদের সমাজে মিশে যাবে, এটা আমাদের ভাবতেও অবাক লাগছিল।”

“কয়েক মিনিটের মধ্যেই জানাজা শেষ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে ওঠার জন্য এগিয়ে আসেন গোলাম আযম। আমার থেকে তখন ১০-১২ ফুট দূরে। হঠাৎ আমার পায়ের স্যান্ডেল হাতে উঠে এল। এগিয়ে গিয়ে পরপর দুটো আঘাত করলাম। প্রথমটা লাগলো কপালে, দ্বিতীয়টা চেয়ালে।”

এরপর গোলাম আযমের সঙ্গে থাকা অন্যরা তাকে আড়াল করে গাড়িতে তুলে সেখান থেকে সরে পড়ে বলে জানান ওই ব্যক্তি।

তিনি জানান, ওই ঘটনার মাত্র দুটি ছবি তুলেছিলেন তখন দৈনিক সংবাদে কাজ করা রশীদ তালুকদার। একটি ছবি পরদিন সংবাদে ছাপা হয়েছিল।

জুতাপেটার পরপর ঘটনাস্থলের কাছে জামায়াতকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছিলেন এই ব্যক্তি।

“জিরো পয়েন্টের কিছুটা এগুতেই কয়েকজন এসে জোর করে আমাকে গাড়িতে তুলতে চায়। তাদের সঙ্গে আমার ধস্তাধ্বস্তির এক পর্যায়ে জাসদ নেতা প্রয়াত কাজী আরেফ আহমেদ ও তার সঙ্গীরা এসে আমাকে উদ্ধার করেন।”

কেন জুতা মারতে গেলেন- জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “চরম ঘৃণা থেকেই তাকে মেরেছিলাম। একজন স্বাধীনতাবিরোধী, একজন দেশদ্রোহী, যারা নেতৃত্ব অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তিনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াবেন- এটা কি মেনে নেয়া যায়?”

সাংবাদিক মুনীরুজ্জামান বলেন, জানাজায় এসে গোলাম আযম জুতাপেটার পাশাপাশি কিল-ঘুষিও খেয়েছিলেন বলে তারা শুনেছেন।

“পরদিন তখনকার প্রায় সব পত্রিকাতেই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদে জুতোপেটার ছবিও ছাপা হয়েছিল। একাধিক ছাত্র সংগঠন এ ঘটনা নিয়ে বিবৃতিও দিয়েছিল।”

বেশ কিছুদিন ধরেই সংবাদপত্রে কলাম লেখকদের লেখনিতে তা উঠে এসেছিল বলে এই সাংবাদিক জানান।