ষড়যন্ত্র, উস্কানি, ও হত্যা-নির্যাতনের ৫ অভিযোগ

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে যারা বাঙালি হত্যা-নির্যাতনে নেমেছিলেন, তখনকার জামায়াত আমীর গোলাম আযম তাদের নেতৃত্বে ছিলেন বলে অভিযোগ এনেছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনোলের প্রসিকিউশন। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2013, 01:09 AM
Updated : 14 July 2013, 01:11 AM

পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র, সহযোগিতা করা, উস্কানি দেয়া,  সম্পৃক্ততা ও বাধা না দেওয়া এবং ব্যক্তিগতভাবে নির্যাতনে জড়িত থাকার পাঁচ ধরনের অভিযোগে তার বিচার শেষে সোমবার রায় ঘোষণা করবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। 

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত ছয়টি, তাদের সহযোগিতা করার তিনটি, উস্কানি দেয়ার ২৮টি, তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেয়ার ২৩টি এবং হত্যা ও নির্যাতনের একটি অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ ১

একাত্তরে এক বৈঠকে গোলাম আযম, রাও ফরমান আলী ও এম এ মালেক

প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল গোলাম আযম, নুরুল আমীন, মৌলভী ফরিদ আহমেদ, খাজা খয়েরউদ্দিন, এ কে এম শফিকুল ইসলাম, মাওলান নুরুজ্জামান, হামিদুল হক চৌধুরী, মোহসিনউদ্দিন আহমেদ, এ টি সাদীসহ ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের ষড়যন্ত্র করেন।

তারই সূত্র ধরে ৬ এপ্রিল গোলাম আযম আবারও টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং ওই ষড়যন্ত্রে অংশ নেন। এই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ১৯ জুন রাওয়ালপিণ্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক করেন গোলাম আযম। ১ ডিসেম্বর সেখানে আবারো ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে দমনের জন্য রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

অভিযোগ ২

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে সারা দেশে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ এপ্রিল গোলাম আযম ও অন্যরা ঢাকায় ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করেন। এরপর ৪ মে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে এ কিউ এম শফিকুল ইসলামের বাসভবনে গোলাম আযম উপস্থিতিতে শান্তি কমিটির সভা হয়।

খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে ওই সভায় ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনা করা হয়।

অভিযোগ ৩

মানবতাবিরোধী অপরাধে উস্কানি দেয়ার ২৮টি ঘটনার কথা বলা হয়েছে প্রসিকিউশনের অভিযোগে।

এতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল গোলাম আযম এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যায়িত করে তাদের ধ্বংস করার আহ্বান জানান।

২২ এপ্রিল শান্তি কমিটির সভা শেষে এক বিবৃতিতে গোলাম আযমের নিয়ন্ত্রণে থাকা সংগঠনগুলোর সদস্যদের ‘দেশপ্রেমিক নাগরিক’ উল্লেখ করে দেশের সাধারণ নাগরিকদের ধ্বংস করার আহ্বান জানানো হয়।

১৭ মে গোলাম আযম ঢাকায় এক সভায় স্বাধীনতা আন্দোলনকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ’ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করেন। সেই সঙ্গে ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহা স্তব্ধ করে দিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নমে যে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায়, তারও প্রশংসা করেন জামায়াতের তথনকার আমির।

এরপর ১৬ জুলাই রাজশাহী, ১৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৪ অগাস্ট খুলনা, ৭ অগাস্ট কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায় আয়োজিত সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও উত্তেজনাকর বক্তব্য দেন গোলাম আযম। ১৪ অগাস্ট পাকিস্তানের ২৫তম আজাদী দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে, ১৭ ও ২৩ অগাস্ট দলীয় সভায় এবং ২৬ অগাস্ট পেশোয়ারে জামায়াতে ইসলামীর অনুষ্ঠানেও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন।

১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে রাজাকারদের প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করে তাদের সশস্ত্র হওয়ার আহ্বান জানান গোলাম আযম। ৩ অক্টোবর ঢাকায় জামায়াতের মজলিসে শুরার সভায় একই ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন তিনি।

অভিযোগ ৪

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে চতুর্থ অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা বা সম্পৃক্ততার ২৩টি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।

প্রসিকিউশন বলছে, গোলাম আযমসহ অন্যরা একাত্তরের ৪ ও ৬ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। গোলাম আযমের সহযোগিতায় ৯ এপ্রিল নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এরপর ১৫ এপ্রিল এর নাম বদলে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি করা হয়। শান্তি কমিটির ২১ সদস্যের কার্যকরী কমিটিরও সদস্য ছিলেন তিনি।

১৮ জুন পাকিস্তানের লাহোর বিমানবন্দরে গোলাম আযম বলেন, জনগণ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে চায়। ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে তিনি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবিলার জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানান। পরদিন লাহোরে জামায়াতের পশ্চিম পাকিস্তান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ‘দুষ্কৃতকারীরা’ সক্রিয় রয়েছে এবং তাদের প্রতিরোধে ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রসজ্জিত হওয়া উচিত।

অভিযোগ ৫

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পঞ্চম অভিযোগে হত্যা ও নির্যাতনের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছে প্রসিকিউশন।

এতে বলা হয়, কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের সিরু মিয়া একাত্তরে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় দারোগা (সাব-ইন্সপেক্টর) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৮ মার্চ তিনি স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ও ১৪ বছরের ছেলে আনোয়ার কামালকে নিয়ে কুমিল্লায় নিজের বাড়িতে যান। সেখানে শরণার্থীদের ভারতে যাতায়াতে সাহায্য করতেন সিরু মিয়া।

সিরু মিয়া ও তার ছেলেসহ ছয়জন ভারতে যাওয়ার সময় ২৭ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে কসবা থানার তন্তর চেকপোস্টের কাছে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। তাদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে কয়েক দিন নির্যাতনের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে পাঠানো হয়।

এদিকে, স্বামী-সন্তানের ধরা পড়ার খবর পেয়ে সিরু মিয়ার স্ত্রী গোলাম আযমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সিরু মিয়ার ভগ্নিপতি ছিলেন গোলাম আযমের দুই ছেলে আজমী ও আমীনের শিক্ষক। তিনি গোলাম আযমের কাছে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে মুক্তি দিতে অনুরোধ জানান।

বিষয়টি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তি কমিটির নেতা পেয়ারা মিয়াকে একটি চিঠি পাঠান গোলাম আযম, যাতে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। চিঠি পাওয়ার পর ঈদের দিন রাতে রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা সিরু মিয়াসহ ৩৯ জনকে কারাগার থেকে পৈরতলা রেল সেতুর কাছে নিয়ে যায়। সেখানে হানাদারদের গুলিতে ৩৮ জন মারা গেলেও একজন প্রাণে বেঁচে যান।