১৫ মিনিটের দক্ষযজ্ঞ

দিনভর সংঘর্ষের পর রাত ৮টার দিকে পল্টন থেকে দৈনিক বাংলা পর্যন্ত সড়কের নিয়ন্ত্রণ নেয় পুলিশ। এ সময় হেফাজত কর্মীদের দুটি গ্রুপ বিচ্ছিন্ন হয়ে বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক ও ফকিরাপুল পানির ট্যাঙ্কের দিকে অবস্থান নেয়।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2013, 01:15 PM
Updated : 6 May 2013, 01:48 PM

বিজয়নগরের দিকের হেফাজতের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ থেমে থেমে রাত এগারোটা পর্যন্ত চলে। রাত ১০টার পর পুলিশের একটি দল টিয়ার সেল ছুড়তে ছুড়তে বিজয়নগরের দিকে এগিয়ে যায়। এদলটিই ছত্রভঙ্গ করে বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কের পাশে অবস্থান নেয়া হেফাজতকর্মীদের।

পল্টন থেকে দৈনিক বাংলা পর্যন্ত সড়ক পুলিশ নিয়ন্ত্রণে নিলে শত শত হেফাজতকর্মী ঢুকে পড়ে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে।এ সময় মসজিদটির দক্ষিণ গেটে কিছুক্ষণ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে।

রাত আটটার পরে হেফাজত কর্মীদের ধাওয়া দিয়ে এগিয়ে যাওয়া আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অগ্রযাত্রা দৈনিক বাংলা মোড়ে গিয়ে থেমে গেলেও হেফাজত কর্মীরা মতিঝিলের দিকে সরে যায়। এ সময় তারা জনতা ব্যাংক টাওয়ার ও সিটি সেন্টারের সামনে পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেয়। অনেকে চলে যায় দিলকুশার ভেতরের দিকেও।

বঙ্গভবনের পাশ দিয়ে দিলকুশার এই পথে বিপুল পরিমাণ র‌্যাব সদস্য কয়েকদফা করে এগুনোর চেষ্টা চালায়। তবে তাতে কাজ হয়নি। রাত সাড়ে ১১টার দিকে র্যাবের অন্তত ৬০০ সদস্য পল্টন মোড়ে এসে অবস্থান নেয়।

এদিকে রাত সাড়ে নয়টার দিকেও শত শত পুলিশে ভরা ছিলো পল্টন মোড়। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তারা ধীরে ধীরে দৈনিক বাংলা বা জিরো পয়েন্টের দিকে এগিয়ে যায়। এ সময় এখানে এসে কাজে যোগ দিচ্ছিলো নতুন সদস্যরা।

রাত সাড়ে বারোটার দিকে বিজিবির সদস্যরা হাই কোর্টের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামে। সেখান থেকে খুব আস্তে আস্তে অগ্রসর হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেয়।

রাত সোয়া ১টার দিকে র‌্যাব সদস্যরা পল্টন হয়ে মতিঝিলের দিকে এগুতে শুরু করেন। র‌্যাবের পেছনে এগিয়ে যায় পুলিশও। একই ধরনের অভিযান শুরু হয় নটরডেম কলেজের দিক থেকেও। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বায়তুল মোকাররমের পাশ ধরে এগিয়ে যাওয়ার সময় একদল হেফাজত কর্মীদের উত্তর গেটের সিঁড়িতে এসে অবস্থান নিতে দেখা যায়। তবে তাদের দিক থেকে বাধা না আসায় এক পর্যায়ে তাদেরকে পেছনে রেখেই এগিয়ে যায় র‌্যাব পুলিশ। এসময় বিজিবির সদস্যরা এগিয়ে এসে পল্টন মোড়ে অবস্থান নেয়।

রাত দেড়টার দিকে দৈনিক বাংলা মোড় পেরিয়ে সিটি সেন্টারের সামনে র‌্যাব ও পুলিশ অবস্থান নিলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৃক্তৃতা থামিয়ে মুহুর্মুহু স্লো্গান আসতে থাকে মঞ্চ থেকে। কিছুক্ষণ স্লোগানের পর ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ.. হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ দলীয় সংগীত চলতে থাকে।

এই সময় সিটি সেন্টারের সামনে খুব কাছাকাছি অবস্থান নেয় উভয় পক্ষ। এখানে এক ঘণ্টা মুখোমুখি অবস্থানে থাকে দুইপক্ষ। আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থানের সামনে থাকা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা হ্যান্ড মাইকে মতিঝিল চত্বর ছাড়ার আহ্বান জানাতে থাকেন। যার বিপরীত দিক থেকে স্লোগান ও হইচইয়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।

এ সময় হেফাজত মঞ্চের মাইকে ঘোষণা করা হয়, ছাত্রলীগ-র‌্যাব-পুলিশের সশস্ত্র সদস্যরা আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। আপনারা সতর্ক থাকুন।

রাত আড়াইটার পর অবস্থান ছেড়ে দিতে চূড়ান্ত সতর্ক বার্তা দিয়ে অভিযান শুরু করে দেয় র‌্যাব পুলিশ। অভিযানের শুরুতে র‌্যাব টিয়ার গ্যাস সেল এবং গ্যাস নিক্ষেপ করে। বিপরীতে এ সময় কয়েকটি হাতবোমা বিস্ফোরণ ঘটায় হেফাজতকর্মীরা।

প্রথম দফায় এক টানা বেশ কিছুক্ষণ টিয়ার গ্যাস শেল নিক্ষেপ এবং গ্যাস স্প্রের পর ঝাঁজ পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ও গ্যাস নিক্ষেপের পর ঝাঁজ পুরো এলাকায় ছড়িযে পড়ে। বাতাসের কারণে নিক্ষেপকারীরাই অধিক ঝাঁজের মুখে পড়েন। হেফাজতের অবস্থানের দিকে রাস্তায় প্রচুর আগুন জ্বালানো থাকায় টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের পরও তাদের অবস্থান টলেনি।

এ সময় টিয়ার গ্যাস সেলের ঝাঁজে বিপরীত ক্রিয়ার মুখে পড়ে পিছু হটে র‌্যাব পুলিশ দৈনিক বাংলার পশ্চিম পাশে ফিরে আসে । সেখানে তখনো বিকালের আগুন জ্বলছিলো। র‌্যাব পুলিশ আশপাশ থেকে কাগজ কুড়িয়ে এনে আগুন ধরায়। চোখ স্বাভাবিক হয়ে এলে তারা আবারো অগ্রসর হয়।

রাত পৌনে তিনটার দিকে দৈনিক বাংলার দক্ষিণ পাশ থেকে শুরু হয় দুই দিক থেকে কঠোর অভিযান। অভিযান শুরুর সময়ও মঞ্চ থেকে নানা স্লোগান দেয়া হলেও কয়েকমিনিটের মধ্যেই মাইক বন্ধ হয়ে যায়। স্লোগানে একটা একটা নাস্তিক ধর/ধইরা ধইরা জবাই করা, অ্যাকশন-অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন, র‌্যাব পুলিশের বিরুদ্ধে/ডাইরেক্ট অ্যাকশন-প্রভৃতি স্লোগান দেয়া হয়।

এ সময় ১০ মিনিটের মধ্যেই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসে মিলিত হয় শাপলা চত্বরে। যা নিয়ে মূল অভিযানে মোট সময় লাগে ১৫মিনিট।

শাপলা চত্বরে অগ্রসর হওয়ার সময় পুলিশ বেশ কয়েকজন হেফাজত কর্মী ধরে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটায়। মতিঝিল পৌছুতে পৌছুতেই পিটুনিতে অন্তত আটজন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অবশ্য এদের কাউকে কাউকে পুলিশ চলে যাওয়ার পর দৌড়ে চলে যেতে দেখা যায়।

সোনালী ব্যাংকের পার্শ্ববর্তী একটি ভবনের মূল কাঠামোর বাইরের দুই তলার ছাদে শুয়ে ছিলো ২০-২৫ জন। সেখানে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে তাদেরকে সেখান থেকে নামিয়ে আনে আইন শৃঙ্খলারকারী বাহিনী। নামানোর পর কয়েকজন র‌্যাক-পুলিশ তাদের পেটাতে থাকে। এ সময় অন্য সদস্যরা এসে তাদেরকে থামায়। তবে এর মধ্যেই ওই ভবনের সামনেই পড়ে ছিলো এক ব্যক্তি। তবে উপস্থিত পুলিশ নাড়ি ধরে তার জীবন আছে বলে নিশ্চিত করে। পরে পুলিশের একটি গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।

এ সময় এই ভবনে সীমানা প্রাচীরের ভিতর থেকে আহত কয়েকজনকে বের করে আনে পুলিশ। যারা সেখানেই বসে ছিলো। এ সময় এক পুলিশ সদস্য তাদেরকে পেটানো শুরু করলে অন্য সদস্যরা তাকে থামায়। তবে এর মধ্যেই বসে থাকাদের একজন লুটিয়ে পড়েন।

পরে তাদেরকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলে সুস্থরা আহতদেরকে নিয়ে মতিঝিল এলাকা ছেড়ে যায়। নটরডেম কলেজের দিক থেকে আসা সড়কে হাতের বাম পাশে পড়ে ছিলো ৬জন। এদের একজনের মাথা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তার পোশাক রক্তে রঞ্জিত ছিলো।

শাপলা চত্ত্বরে পুলিশ পৌছার কিছুক্ষণ পরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এই ব্যক্তির চেতনা নেই। তখন তার পাশে পড়ে থাকা অন্যদের পুলিশ এক সাংবাদিক থেকে পানি নিয়ে পানি খেতে দেয়। তাদের মধ্যে একজন বসে বাকীরা শুয়েই পানি পান করে।

এখানে এক ঘণ্টার কাছাকাছি সময় পড়ে থাকার পর তাদেরকে গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যায় পুলিশ।

এদিকে শাপলা চত্বরে পৌছার পর সোনালী ব্যাংকের সামনে শিশু ও কিশোরসহ একদল মানুষ অবস্থান করছিলো। পুলিশ সেখানে ফায়ার করতে করতে এগিয়ে যায়। সেখানে পুলিশী অভিযান শেষ হওয়ার পর সিড়িতে ৬জনকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। যাদের প্রায় সবার পোশাকই রক্ত মাখা দেখা যায়।

এদের মধ্যে ১৪-১৫ বছরের একটি শিশুকেও দেখা যায়। তার নিথর হাত ধরে পুলিশ জানায়, সে আর বেঁচে নেই।

এর কিছুক্ষণ পরই সোনালী ব্যাংকের ভিতরে হেফাজতের সমাবেশে আসা বিপুল পরিমাণ শিশু-কিশোরসহ অনেকের উপস্থিতি টের পায় পুলিশ। তাদেরকে একে একে বের করে আনা হয়। এই ভবনে সামনে দিকে দোতলার বর্ধিত ছাদ এবং পশ্চিম পাশের সীমানা প্রাচীরের ভেতর থেকে কয়েকশত লোককে বের করে সোনালী ব্যাংকের সামনে এনে বসিয়ে রাখা হয়। কিছুক্ষণ পর তাদেরকে নটরডেম কলেজের দিকে বের করে দেয়া হয়। এরপর একে একে সোনালী ব্যাংকের ভিতর থেকে বিভিন্ন অবস্থানে থাকাদেরও বের করে আনতে থাকে পুলিশ। যাদের সংখ্যা শেষ পর্যন্ত কয়েক হাজারে পৌছে। সকাল পর্যন্ত এদেরকে শাপলা চত্বর এলাকা থেকে বের করে দেয়া হতে থাকে।

মাঝামাঝি সময়ে এসে কয়েকজন পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য এসব মানুষকে হাতের লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। এই পিটুনের মুখে পড়ে বেশ কিছু শিশুও। যারা পিটুনির পর মাগো, বাবাগো করে চিত্কার দিয়ে উঠে দৌড় দেয়। বের হওয়ার সময় এদের প্রায় সবাই হাত উচিয়ে আবার কেউ কান ধরে এলাকা ত্যাগ করে।

শেষ রাতের দিকে বিভিন্ন গলি থেকে এভাবে অনেককে ধরে এনে উত্তর দিকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় পুলিশ। এ সময় কেউ কেউ পিটুনি শিকারও হন।

রাত তিনটার দিকে শাপলা চত্বরে পৌছার পরই শাপলার পশ্চিম-উত্তর কোণে প্লাস্টিকে ঢাকা তিনটি লাশ দেখা যায়। লাশগুলো দেখেই মনে হচ্ছিল, এদের মৃত্যু অন্তত কয়েক ঘণ্টা পূর্বে হয়েছে। ঘণ্টা খানেক পর এখানে আরো একটি লাখ দেখা যায়।

রাত ৪টার পরে একটি পুলিশের গাড়ি ও একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয়।

পুলিশ শাপলা চত্বরে পৌছার পর আশে পাশের গলিগুলো থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন হেফাজত কর্মীরা।  ইত্তেফাক, মধুমিতা হলের গলি, মতিঝিল থেকে ইত্তেফাকের দিকে হাত ডান পাশের প্রথম গলিতে প্রতিরোধের চেষ্টা করে হেফাজত কর্মীরা। থেমে থেমে তাদের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে। পুলিশ ফায়ার করে অন্যদিকে হেফাজত কর্মীরা ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে।

ফজরের আজানের পর পুলিশ এ সব গলিতেও প্রবেশ করে হেফাজত কর্মীদের ধরে ওই এলাকা থেকে বের করে দেয়।

পুলিশের টিয়ার সেলের ঝাঁজ থেকে বাঁচতে অনেকটা বেপরোয়া ভাবই দেখিয়েছে হেফাজত কর্মীরা। তাদের পিছু হটার সময়ে আশে পাশে পোড়ানো মত প্রায় সব কিছুতে তারা আগুন দেয়। এরপরও অধিকাংশ স্থানেই হেফাজতের প্রতিরোধ দুর্গ অল্পক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়ে সব জায়গায়।

মতিঝিল থেকে চলে যাওয়ার সময় বিপুল পরিমাণ পাউরুটি-কলা-পানি ফেলে রেখে যায় হেফাজতকর্মীরা, যার অধিকাংশই হুড়োহুড়ির কারণে নষ্ট হয়ে যায়। পড়ে ছিলো হাজার হাজার জুতোও।

পুলিশ ও অন্য আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অনেককে ওই পানি পান  করতে দেখা গেছে।

ডিভাইডারের ভাঙা, সংঘর্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইট, জ্বলন্ত কয়লার স্তুপ, ছাই, পুড়ে যাওয়া গাড়িসহ বিভিন্ন কিছু কাঠামো দিয়ে পল্টন থেকে ইত্তেফাক পর্যন্ত এলাকা যুদ্ধ শেষের পরিত্যক্ত ক্ষেত্রে পরিস্থিতি হয়। সাড়ে চারটার পর থেকে এগুলো পরিস্কার করা শুরু হয়।

সকাল পাঁচটার পর সাউন্ড গ্রেনেড আর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের আওয়াজ কমে আসার পর এলাকাবাসী নেমে আসে রাস্তায়। যাদের সঙ্গে মিশে বিভিন্ন গলিপথে লুকিয়ে থাকা অনেক হেফাজত কর্মী রাস্তায় বের হয়ে আসে। বায়তুল মোকাররম থেকে অনেকে বের হয়ে গন্তব্যের পথ ধরে।