কামারুজ্জামানের রায় যে কোনো দিন

যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছে ট্রাইব্যুনাল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2013, 01:17 AM
Updated : 16 April 2013, 06:48 AM

ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামান

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্যকরাসহ সাত ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে।

মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ, এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও নুরজাহান বেগম মুক্তা আসামিপক্ষের বক্তব্যের পাল্টা যুক্তি এবং প্রসিকিউশনের সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

কামারুজ্জামানের পক্ষে গত বৃহস্পতিবার যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।

দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে। এখন যে কোনো দিন এ মামলার রায় দিতে পারে ট্রাইব্যুনাল।

এর আগে যুদ্ধাপরাধের তিনটি মামলার রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে প্রথম রায়ে জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে।

দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন এবং তৃতীয় রায়ে দলটির নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।   

মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালে যুক্তি উপস্থাপনের সময় তুরিন আফরোফ বলেন, সাক্ষীদের জবানবন্দি প্রমাণ করেছে যে মোহাম্মদ কামারুজ্জামান মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিলেন। আলবদর বাহিনীর নেতা হিসেবে তার নির্দেশে, ভূমিকায় ও সহযোগিতায় শেরপুরে যুদ্ধপারাধ সংগঠিত হয়।

নূরজাহান মুক্তা বলেন, কামারুজ্জামানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুক্তিকামী নারীদের ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তাদের তিনজন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, শেরপুরের অধ্যক্ষ হান্নানর মুখে চুন কালি মাখিয়ে মাথা মুড়িয়ে নির্যাতন করেছিল আলবদর বাহিনী। তার সঙ্গে যা ঘটেছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ।

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এ মামলা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “অনেক সময় নানা কারণে অনেককে ধমক দিতে হয়েছে। এটা কেউ ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না।”

ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে এহসান সিদ্দিক যেভাবে আসামির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, তারও প্রশংসা করেন বিচারক।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিচার শুরু হয়।

প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন। ২২ এপ্রিল তিনি জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন।

এই বাহিনী বৃহত্তর ময়মনসিংহে (ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইল) গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ ঘটায় বলে অভিযোগ করেছে প্রসিকিউশন।

বদিউজ্জামানকে হত্যা

প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে একাত্তর সালের ২৯ জুন শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী থানার কালীনগর গ্রামে ফজলুল হকের ছেলে বদিউজ্জামানকে রামনগর গ্রামের আহম্মদ মেম্বারের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা।

এরপর তাকে নির্যাতন করে আহম্মদনগরের রাস্তার ওপরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে লাশ টেনে নিয়ে কাছাকাছি কাঠের পুলের নিচে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।

প্রভাষক আব্দুল হান্নানকে নির্যাতন

একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি এক দুপুরে শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে খালি গায়ে মাথা ন্যাড়া করে, গায়ে ও মুখে চুনকালি মাখিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় চাবুক দিয়ে পেটাতে পেটাতে শেরপুর শহর ঘোরায় আসামি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা।

সোহাগপুরে গণহত্যা

একাত্তরের ২৫ জুলাই ভোর বেলায় কামারুজ্জামানের পরিকল্পনা ও পরামর্শে রাজাকার, আলবদরসহ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। এরপর তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১২০ জন পুরুষকে ধরে এনে হত্যা করে। ধর্ষণের শিকার হন গ্রামের মহিলারা।

গোলাম মোস্তফাকে হত্যা

১৯৭১ সালের ২৩ অগাস্ট মাগরিবের নামাজের সময় গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। কামারুজ্জামানের নির্দেশে তাকে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে বসানো আলবদর ক্যাম্পে রাখা হয়।

মোস্তফার চাচা তোফায়েল ইসলাম এরপর কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করে তার ভাতিজাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ওই রাতে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাশেম নামের আরেক ব্যক্তিকে মৃগি নদীর ওপর শেরি ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গুলি করে।

গুলিতে গোলাম মোস্তফা নিহত হলেও হাতের আঙ্গুলে গুলি লাগায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান আবুল কাশেম।

লিয়াকতসহ ৮ জনকে হত্যা

একাত্তরে রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক সন্ধ্যায় শেরপুরের চকবাজারের বাসা থেকে মো. লিয়াকত আলী ও আরো ১১ জনকে আটক করে ঝিনাইগাতী আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। এরপর তিনজন ছাড়া বাকি সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

গুলি করার সময় আসামি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগ করেছে প্রসিকিউশন।

দিদারসহ কয়েকজনকে নির্যাতন

একাত্তরের নভেম্বর মাসে দিদারসহ কয়েকজনকে ময়মনসিংহ শহরের জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। পাকিস্তানের পক্ষে বক্তব্য দিতে বাধ্য করতে সেখানে নির্যাতন চলে তাদের ওপর।

টেপা মিয়াসহ ৫ জনকে হত্যা

একাত্তরে ২৭ রোজার দিন দুপুরে টেপা মিয়ার বাড়ি ঘেড়াও করে আলবদর বাহিনী। এরপর কামারুজ্জামানের নির্দেশে টেপা মিয়াসহ ৫ জনকে হত্যা করা হয়।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিবরণ অনুযায়ী, কামারুজ্জামান এসব অপরাধ করেছেন একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে। তার বিচরণক্ষেত্র ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন গত ১৫ জানুয়ারি এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ৩১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেয়। পরে মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে গত বছরের ২১ জুলাই তদন্ত শুরু হয়। ওই বছরের ২ অগাস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।