‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্য দিয়ে বার বার শিরোনামে

একজন বিচারকের কথিত স্কাইপ কথপোকথন প্রকাশ ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার মাহমুদুর রহমান তার ‘উস্কানিমূলক ও বিতর্কিত’ বক্তব্যের জন্য আলেচিত সমালোচিত হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। 

রিয়াজুল বাশারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2013, 00:43 AM
Updated : 23 Nov 2016, 01:03 PM

প্রকৌশলের ছাত্র মাহমুদুরের পেশাজীবনের উত্তরণ ঘটে দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপ বেক্সিমকোর মাধ্যমে। তবে পরে বিএনপি সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেন।  

মাহমুদুর রহমানের জন্ম ১৯৫৩ সালে কুমিল্লায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৭ সালে ডিগ্রি নিয়ে তার কর্মজীবন শুরু হয় বহুজাতিক কোম্পানি লিনডে গ্রুপের ব্রিটিশ অক্সিজেন কোম্পানিতে। বিয়ে করেন বিএনপি আমলের সাবেক মন্ত্রী হারুন অর রশীদ খান মুন্নুর মেয়ে ফিরোজা খানকে।

পরে বিসিআইসি, মুন্নু সিরামিক এবং বেক্সিমকো গ্রুপের শাইনপুকুর সিরামিকসে মধ্যম সারির এক্সিকিউটিভ পদে চাকরি করেন তিনি।

শাইনপুকুরের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে থাকা অবস্থাতেই বিগত বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময়ে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান হন মাহমুদুর।  সে সময় বাংলাদেশে টাটার বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে সরকারের আলোচনায় নেতৃত্ব দেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, বিনিয়োগ বোর্ডের চাকরিতে থাকা অবস্থায়ও মাহমুদুর বেক্সিমকো থেকে বেতন গ্রহণ করতেন। 

বিএনপি সরকারের শেষভাগে এসে কিছুদিনের জন্য প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন মাহমুদুর।

সে সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নিজেই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তবে কার্যত মাহমুদুরই মন্ত্রণালয়ের দেখভাল করতেন।

উপদেষ্টা থাকার দিনগুলোতেও বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য বহুবার সংবাদপত্রের শিরোনামে আসেন মাহমুদুর।

২০০৬ সালের অগাস্টে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, নির্বাহী পরিচালক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সৈয়দ মনজুর এলাহী, এম সাইদুজ্জামান ও লায়লা রহমান কবিরের বিরুদ্ধে মামলা করেন মাহমুদুর রহমান। 

তার অভিযোগ ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘বাংলাদেশবিরোধী’ কর্মকাণ্ডে তার পরিবারকে জড়িয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন সিপিডির ওই কর্মকর্তারা। 

মাঝখানে কিছুদিন দেশের বাইরে থাকা মাহমুদুর ১৯৯৯ সালে আরটিসান সিরামিকস নামে নিজের কোম্পানি খোলেন।

উত্তরায় ওই কোম্পানির কার্যালয়েই ২০০৬ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে পুলিশসহ জনপ্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বৈঠকে বসেন তিনি। খবর পেয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে গেলে বৈঠকে যোগ দেওয়া অনেক কর্মকর্তা মুখ ঢেকে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

পরে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াত জোটকে আবারো ক্ষমতায় বসাতেই ওই গোপন বৈঠকের ব্যবস্থা করেন মাহমুদুর। ঘটনাটি সে সময় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। 

এক পর্যায়ে  ২০০৮ সালে আর্থিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত আমার দেশের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন মাহমুদুর রহমান। তখন থেকেই তিনি ওই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। 

সাংবদিকতার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও বিভিন্ন সময়ে আমার দেশের প্রথম পাতায় বিভিন্ন মন্তব্য প্রতিবেদন (কমেন্ট্রি) লেখা শুরু করেন তিনি।  সেসব লেখায় তার বিভিন্ন বক্তব্য এবং আমার দেশের সাংবাদিকতার মান নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন ওঠে।  

গত বছরের শেষ দিকে ব্রাসেলসভিত্তিক আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রধান নিজামুল হকের কথিত স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশ করে দৈনিক আমার দেশ। এর মধ্য দিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসেন পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।

কথিত ওই ব্যক্তিগত কথোপকথন পত্রিকায় প্রকাশের ঘটনায়  গত ১৪ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনোলের প্রসিকিউটর শাহীনুর রহমান তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন, যার আসামি হিসাবে বৃহস্পতিবার সকালে গ্রেপ্তার করা হয় মাহমুদুর রহমানকে। 

বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টির অভিযোগে শাহবাগের গণজাগরন মঞ্চও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে আসছিল।

গত জানুয়ারি মাসে ‘আলেমদের নির্যাতনের প্রতিবাদে কাবার ইমামদের মানববন্ধন’ শিরোনামে আমার দেশের অনলাইন সংস্করণে একটি ‘মিথ্যা সংবাদ’ প্রকাশের পর তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। পরে সংবাদটি প্রত্যাহার করা হয়।

শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলন শুরুর  পর থেকেই বিভিন্ন ‘উস্কানিমূলক’ প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে আমার দেশ।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটির শিরোনাম ছিল- “শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি: গৃহযুদ্ধের উস্কানি, বক্তাদের গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার : আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের রণহুঙ্কার।”

ওইদিনের আরেকটি শিরোনাম ছিল- “ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় এসেছে।”

শাগবাগ আন্দোলনের মধ্যেই ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার নিহত হওয়ার পর ঢালাওভাবে আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক’ আখ্যায়িত করে প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে আমার দেশ।

১৮ ফেব্রুয়ারি তাদের প্রধান শিরোনাম ছিল- “ভয়ঙ্কর ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারচক্র।”

সংবাদটি শুরু হয়েছে এভাবে, “ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক যুবগোষ্ঠী মহান আল্লাহ, পবিত্র গ্রন্থ কোরআন, মহানবী হজরত মোহাম্মদ (স.), ঈদ, নামায, রোজা ও হজ সম্পর্কে জঘন্য ভাষায় বিষোদ্গার করে মুসলমানদের ইমান-আকীদায় আঘাত হানছে। তাদের কুৎসিত ও অশ্লীল লেখা পড়লে যে কোনো মুসলমানের স্থির থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।... ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শুক্রবার রাতে মিরপুরে খুন হওয়া শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা আহমেদ রাজীব হায়দার ওরফে থাবা বাবা।”

এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি ‘ব্লগারদের ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণায় আলেমদের ক্ষোভ: নাস্তিকদের প্রতিরোধে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা’; ২০ ফেব্রুয়ারি ‘ব্লগে নাস্তিকতার নামে কুৎসিত অসভ্যতা’; ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তির জন্য শাস্তি : রাসুল (সা.) অবমাননাকারীদের বাহবা!’; ২২ ফেব্রুয়ারি ‘ধর্ম ও আদালত অবমাননা করছে ব্লগারচক্র’; ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘রাসুল (সা.) অবমাননার প্রতিবাদে গণবিস্ফোরণ: গাইবান্ধায় নিহত ৩ সিলেটে ১ ঝিনাইদহে ১ সারাদেশে আহত ৪ হাজার’; ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘পুলিশের নির্বিচারে আলেম হত্যা: স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল’ শিরোনামে একের পর এক উস্কানিমূলক সংবাদ প্রকাশ করে পত্রিকাটি।

যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের দুদিন আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি আমার দেশের প্রধান শিরোনাম ছিল- ‘চট্টগ্রামে পেশাজীবীদের বিশাল সমাবেশে বক্তারা: নাস্তিকদের পৃষ্ঠপোষক ফ্যাসিবাদী সরকারকে উত্খাত করা হবে: মাহমুদুর রহমান গ্রেপ্তার হলে লাগাতার হরতাল’।

এমনকি সাঈদীর রায়ের দিন ২৮ ফেব্রুয়ারির তারা প্রধান শিরোনাম করে, ‘মাওলানা সাঈদীর রায় আজ: দেশব্যাপী হরতালের ডাক’;

এর ধারাবাহিকতায় গত ৪ এপ্রিলও আমার দেশের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘শাহবাগী ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারবন্দনা: কথিত আন্দোলনের পেছনে ভারতীয় মদতের আরও এক নজির’।