বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “তারা এটা দাবি করেছে। তবে এ রকম কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। কারণ আমাদের বিদ্যমান আইনেই এ বিষয়ে বলা আছে।”
হেফাজতের সমাবেশের দুদিন পর সোমবার বিবিসি অনলাইনে এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সরকার সব সময়ই সব ধর্মের মানুষের অধিকার রক্ষার চেষ্টা করে যাবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিরোধী দলের সমালোচনা নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, সংলাপের জন্য তার ‘দরজা’ খোলা থাকলেও বিরোধী দল তাতে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি।
হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি রাজধানীতে সমাবেশ করে সোমবার হরতাল ডাকে, যার মধ্যে ‘ইসলাম ধর্মের অবমাননা’ রোধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাসের দাবিও রয়েছে।
সরকার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করছে কি না- জানতে চাইলে চাইলে বিবিসির আনবারাসান এথিরজনকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এটি গ্রহণ করা বা প্রত্যাখ্যানের বিষয় নয়। আমি বলব, এটা এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন নেই।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার হেফাজতের সবগুলো দাবিই দেখবে। এর মধ্যে কোনোটি গ্রহণযোগ্য হলে তা পূরণ করা হবে। আর যেসব দাবি ‘গ্রহণযোগ্য নয়’, বা বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার ‘উপযোগী নয়’, সেগুলো পূরণ করা হবে না।
হেফাজতের সঙ্গে থাকা ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো যে ১৩ দফা দাবি তুলেছে, তার মধ্যে কথিত ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের শাস্তির পাশাপাশি নারী ও শিক্ষানীতি বাতিল, নারী-পুরুষের প্রকাশ্যে বিচরণ এবং ভাস্কর্য স্থাপন বন্ধের দাবিও রয়েছে।
সরকার বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করলেও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে চারজন ব্লগারদের গ্রেপ্তার করা হলো কেন- এ প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আইনভঙ্গ হয় এমন লেখালেখির কারণেই ব্লগাররা গ্রেপ্তার হয়েছে।
“কেউ যদি অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার চেষ্টা করে- সে বিষয়ে আমাদের আইন আছে। সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। আমরা ইতোমধ্যে একটি কমিটি কেরছি। এই কমিটি ফেইসবুক, ব্লগসহ ইন্টারনেটে খেয়াল রাখছে। তারা যদি কারো অপরাধের প্রমাণ পায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
ইসলামপন্থীদের মোর্চা হেফাজতের দাবির প্রেক্ষিতে ব্লগারদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে- এমন অভিযোগও উড়িয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশ তার ‘ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য’ থেকে সরে যাচ্ছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা দৃঢ় কণ্ঠে বলেন- “অবশ্যই না।”
“বরং আমরা সংবিধান সংশোধন করে সব ধর্মের মানুষের অধিকার রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। আমার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সব সময় বিশ্বাস করে, সবারই নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে।”
সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াত-বিএনপির বিক্ষোভ-সহিংসতা এবং গুলিতে হতাহতের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘অতিরিক্ত বল প্রয়োগের’ যে অভিযোগ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা এনেছে- সে বিষয়েও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিবিসি।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পদক্ষেপ নিয়েছে। আর আক্রান্ত হয়েছে বলেই তারা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়েছে।
জামায়াতের সহিংসতার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্যকেও হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতায় গত কয়েক মাস ধরেই সারা দেশে সহিংসতা চালিয়ে আসছে জামায়াতে ইসলামী। তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ালে নিহত হয়েছেন পুলিশসহ অন্তত ৮০ জন।
শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের দল, দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরও হামলা হয়েছে।... পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। তারা যখন আক্রান্ত হয়, তখন তাদের কী করা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?”
যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে বলে যে অভিযোগ বিএনপি-জামায়াত জোট করেছে- তাও নাকচ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “যাদের বিচার হচ্ছে তারা কারা? তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ করেছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। এ দেশের নারীদের পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে। নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তারা যা করেছে তা যুদ্ধাপরাধ।
“তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ রয়েছে যে তারা যুদ্ধাপরাধী। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের বিরোধী দল এই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে কেন?”
এই বিচার নিয়ে দেশের মানুষ ‘বিভক্ত’ হয়ে পড়েছে কিনা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বিবিসিকে বলেন, “এটাকে কোনোভাবেই বিভক্তি বলা যাবে না। হাতেগোণা কিছু লোক ট্রাইব্যুনালের বিরোধিতা করছে। তারা খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ, পুরো জাতি নয়।
“বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল এবং মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছিল। আপনি জানেন ভোটের ফল কী হয়েছিল। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এই বিচার জনদাবি।”
বিবিসি প্রতিবেদক আনবারাসান এথিরজন বলেন, “বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে প্রায় ৬ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে এলেও গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উদ্বেগ ও দ্বিধায় ভুগছেন। বিশ্বকে আপনি কী বলবেন? বাংলাদেশ আসলে কী হচ্ছে?”
এর উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নতির ধারায় আছে এবং এ ধারা চলবে। আমরা জানি পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিতে হয়। সুতরাং উদ্বেগের কিছু নেই।”
বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের কোনো উদ্যোগ শেখ হাসিনা সরকার নেবে কি না- জানতে চাইলে এ বিষয়ে বিরোধী দলের নেতিবাচক অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমার দরজা খোলা। আর আপনারা জানেন, এরই মধ্যে আমরা তাদের প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের দিক থেকে যখন প্রস্তাব গেছে তখন তারা প্রত্যাখ্যান করেছে।”
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার পর থেকেই বিএনপি সমমনা দলগুলোকে নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে আসছে।
এই পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মতপার্থক্য অবসানে কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীরাও দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সম্প্রতি সংলাপে তার দলের অনাপত্তির কথা জানান।
কিন্তু বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে সরকার পতনের আন্দোলন শুরুর কথা বলেন।
এই পরিস্থিতিতে এক আইনজীবী হাই কোর্টে রিট আবেদন করলে একটি রুল জারি করে উচ্চ আদালত।
অবাধ ও স্বচ্ছভাবে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে সংসদের ভিতরে-বাইরে রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠানের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়েছে এই রুলে।
বাইরের বিশ্বের কাছে আদালতের এমন তাগিদ ‘অদ্ভুত’ মনে হতে পারে কি না- জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বিবিসিকে বলেন, “এটা আসলেই অদ্ভুত। আমর কাছেও তাই মনে হয়েছে। এটা আদালতের বিষয় না।”
“কিন্তু কেউ একজন সেখানে গেলেন, বললেন, আদালত এ বিষয়ে কী করতে পারে? আদালত কী আদেশ দেবে,” হাসতে হাসতে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
বিষয়টি যেহেতু এখনো আদালতের বিবেচনাধীন, সেহেতু এ বিষয়ে এর বেশি কিছু বলতে চাননি শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আদালতের ফয়সালা হয়ে গেলে তখন হয়তো আমরা প্রতিক্রিয়া দিতে পারব। তখনই আমি দেব।”