‘দানব তুই বাংলা ছাড়’

ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ থেকে ছুড়ছে আগুন। ক্ষিপ্র গতিতে পঞ্চাশ ফুট দেহটা চলছে এঁকেবেঁকে। ‘ভিনদেশী’ এ দানবীয় সরীসৃপ যেন স্বাধীন বাংলার সবকিছু ছারখার করে দিতে চায়।

শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 April 2013, 11:54 PM
Updated : 12 April 2013, 09:45 PM

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে এবার বর্ষবরণ উৎসবের মঙ্গল শোভাযাত্রায় এমন একটি কাল্পনিক প্রাণীকেই হাজির করবেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা।

ঠেলা গাড়ির ওপর কাঠের তৈরি ৩০ ফুট ফ্রেমে চেপে শোভাযাত্রার সামনে এগিয়ে চলবে এই ‘ড্রাগন’।

আয়োজনকরা বলছেন, স্বাধীনতার ৪২তম বার্ষিকীতে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে হবে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা। শত্রুবেশী ‘ড্রাগনের’ সঙ্গে ১৫ ফুট দৈর্ঘ্যের টেপা পতুলের রিকশা, শোলার কুমির, ঘোড়াসহ বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প আর সাহিত্যের নানা দিক উঠে আসবে এতে।

প্রতি বছরই পহেলা বৈশাখে বাঙালির চিরায়ত বর্ষবরণ উৎসবে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। রাজধানীবাসী ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে আসেন এই শোভাযাত্রায় যোগ দিতে।

এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি কাজের সমন্বয়ক মানবেন্দ্র ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন তো সবারই দাবি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। সেই দাবিকেই শোভাযাত্রায় ফুটিয়ে তোলা হবে রূপকের মাধ্যমে।”

“আমরা চাই বাংলা বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-ঐতিহ্য নিয়েই চলবে। কিন্তু অশুভ শক্তি চায় এগুলো মরে যাক। আমরা বাঙালির ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই যুগ-যুগান্তর।”

মানবেন্দ্র জানান, মূল শোভাযাত্রার ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের এই ‘ড্রাগনের’ আদলে ১০-১২ ফুট দৈর্ঘ্যের ‘রেপ্লিকা’ তৈরি করে এবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়া হবে, যাতে সব জায়গায় একইভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়।

এই সরীসৃপের রূপকে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে- এ প্রশ্নের জবাবে ভাস্কর্যের এই শিক্ষার্থী বলেন, “এরা এই মাটির নয়, অন্য দেশের। ওই যে কথায় আছে- বন্যেরা বনে সুন্দর, রাজাকাররা পাকিস্তানে। যারা দেশকে ভালোবাসে না- তারা এদেশে থাকতে পারে না।”

উৎসবে আবেশমুগ্ধ বিদেশি মন

শোভাযাত্রাকে আরো বর্ণিল ও প্রাণবন্ত করতে রঙ-বেরঙের মুখোশ নিয়ে, শোলার পাখি, পেঁচা, প্রজাপতি, খরগোশ ও টেপা পুতুলের সঙ্গে ঢাল-ঢোল-বাঁশি বাজিয়ে, লাঠি-বর্শা, তীর-ধনুক হাতে অনেকেই অংশ নেবেন শোভাযাত্রায়। চারুকলা অনুষদে এখন পুরোদমে চলছে তারই প্রস্তুতি।

অনুষদের মূল ফটকের পাশেই এক দল শিক্ষার্থীকে দেখা গেল মাটির তৈরি ব্যাঙ, হাতি, ঘোড়া, পুতুল ও কলমদানি তৈরি ও বিক্রি করছেন। আরেক দল কাঠ, বাঁশ, মাটিসহ বিভিন্ন উপকরণে গড়ে তুলছেন এক একটি কাঠামো। পরে রঙ বেরঙের কাগজ লাগিয়ে তৈরি হবে মূল প্রতিকৃতি।

অনেক দিন আগে যে উদ্দেশ্য নিয়ে শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন দেখে তাকে স্বার্থক বলেই মনে করছেন গত বছর শোভাযাত্রার প্রস্তুতি কাজের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা মৃৎশিল্পের শিক্ষার্থী নবেন্দু সাহা নব।

তিনি বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুষঙ্গগুলো তৈরির বাইরেও চারুকলার সীমানা প্রাচীরের বাইরের দিক সাজানো হব; আলপনা আঁকা হবে সামনের সড়কে।

“এছাড়া গণজাগরণমূলক লেখা নিয়ে তৈরি হবে টি-শার্ট। সেগুলো পরেই চারুকলার শিক্ষার্থীরা অংশ নেবেন শোভাযাত্রায়।”

একটি আবেদন

মানবেন্দ্র ও নবেন্দু জানান, পেপার ম্যাশ দিয়ে রাজা-রানীর মুখোশ, বড় বড় পেঁচা, বাঘ ও খরগোশের মুখোশসহ শিক্ষার্থীদের তৈরি বিভিন্ন প্রতিকৃতি বিক্রি করেই শোভাযাত্রার খরচ যোগানো হয়। কোনো ‘স্পন্সর’ ছাড়াই প্রতিবার এ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।

“তবে এবার বিক্রি একটু কম। আমরা আপনাদের মাধ্যমে আহ্বান জানাব সবাই যেন কিছু কিনে আমাদের সহায়তা করেন”, বলেন মানবেন্দ্র।

নবেন্দু জানান, ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকেই নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করতে চাইলেও তারা তা নেন না। কোনো কিছু কিনলেই কেবল টাকা নেয়া হয়।

গত ১৩ মার্চ চারুকলা চত্বরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম বিক্রি শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।

আর দশ দিন পরেই বিদায় নেবে বাংলা ১৪১৯ সাল, পহেলা বৈশাখে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি মেতে উঠবে নতুন বর্ষ বরণে।

ইতিহাস বলে, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে বৈশাখ থেকে বাংলা সাল গণনা শুরু হয়। বর্ষ শুরুর সে দিনটিই এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব।

বাদশাহ আকবরের নবরত্ন সভার আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজি বাদশাহি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ফসলি সালের শুরু করেছিলেন হিজরি চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষের মতো মিলিয়ে নিয়ে। তিনিই হিজরিকে বাংলা সালের সঙ্গে সমন্বয় করেছিলেন এবং পয়লা বৈশাখ থেকে বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেছিলেন। আর বৈশাখ নামটি নেয়া হয়েছিলো নক্ষত্র ‘বিশাখা’র নাম থেকে।