প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপির কর্মসূচি গণজাগরণ মঞ্চের

জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন জোরালো করার অঙ্গীকার ঘোষণা করে নতুন কর্মসূচি দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2013, 05:52 AM
Updated : 26 March 2013, 10:15 AM

তবে এই কর্মসূচিকে ‘নমনীয়’ আখ্যা দিয়ে আরো কঠোর কর্মসূচির দাবি উঠেছে মঙ্গলবারের সমাবেশ থেকেই।

জামায়াত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরুর জন্য সরকারকে বেঁধে দেয়া সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর স্বাধীনতা দিবসে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে এই সমাবেশ হয়।

হাজারো জনতার উপস্থিতিতে সন্ধ্যায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতে ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি।

তবে এই কর্মসূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সমাবেশ থেকে আরো কঠোর কর্মসূচির দাবি ওঠে।  

ইমরান কর্মসূচি ঘোষণার সময় সমাবেশের মধ্যে থেকে ‘ঘেরাও-ঘেরাও’ স্লোগান ওঠে। সমাবেশ শেষ হওয়ার পর ঘেরাওয়ের দাবিতে মিছিলও করে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ।

মতিঝিলে বুধবার গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশে ইমরান এইচ সরকার।

কর্মসূচি ঘোষণার সময় ইমরান বলেন, “এই দাবিতে আজ পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেয়া হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় বিক্ষোভ মিছিলসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হবে।”

প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র বলেন, “আপনিও এই দাবির সঙ্গে একমত হবেন। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার দাবি এড়িয়ে যাবেন না।”

গণজাগরণ মঞ্চের ৬টি দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে সংসদে বক্তব্য রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ইমরান বলেন, “আমাদের মূল দাবির পক্ষে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেলেও তা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেই।”

সমাবেশে আরো তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন মঞ্চের মুখপাত্র।

আগামী ৩১ মার্চ সকাল ১১টায় জাতীয় সংসদ অভিমুখে পদযাত্রা হবে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত এবং যুদ্ধাপরাধী-সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ ৬ দফা দাবিতে সংগৃহিত গণস্বাক্ষর স্পিকারের কাছে জমা দেয়া হবে।

৪ এপ্রিল কেন্দ্রীয়ভাবে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়ার পাশাপাশি জেলায় জেলায় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্মারকলিপি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

৫ এপ্রিল বিকাল ৪টায় প্রজন্ম চত্বরে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। পরদিন ৬ এপ্রিল বিকালে হবে সমাবেশ।

কর্মসূচি ঘোষণা করে ইমরান বলেন, “আমরা আমাদের এই অহিংস আন্দোলন বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাব।”

“আমাদের ছয় দফা দাবি গণসংযোগ ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে। কোনো দল, গোষ্ঠী বা সরকার- আমরা কারোর কাছেই দায়বদ্ধ নই।”

গণজাগরণ মঞ্চ সম্পর্কে অপপ্রচারেরও নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান তিনি। এই জন্য পদক্ষেপ নিতে তিনি সরকারের প্রতি দাবিও জানান।

মুক্তিযোদ্ধা-জনতার এই সমাবেশে সিরাজগঞ্জের একদল বীরাঙ্গনাও সংহতি জানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি তোলেন।

একাত্তরের পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা নির্যাতিত এই নারীরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিও দাবি করেন।

ইমরানের বক্তব্য শুরুর আগে গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে সমাবেশে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মঙ্গলপ্রদীপ তুলে দেয়া হয় । এর আগে স্বাধীনতার ৪২ বছর পূর্তিতে ৪২ জন তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেন মুক্তিযোদ্ধারা।
মঙ্গলবারের সমাবেশ সাজানো হয় তিনটি পর্বে। তবে মূল সমাবেশ শুরুর আগে চৈত্রের খরতাপ উপেক্ষা করে মূলমঞ্চে সারিগান পরিবেশন করেন টাঙ্গাইল থেকে আসা শিল্পীরা।

প্রথম পর্বে ছিল ছাত্রনেতাদের বক্তব্য। এ পর্বেই সিরাজগঞ্জ থেকে আসা ১০ জন বীরাঙ্গনাকে পরিচয় করিয়ে দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।

দ্বিতীয় পর্বে ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডারদের বক্তব্য। এ পর্বেই মঙ্গল প্রদীপ এবং জাতীয় পতাকা হস্তান্তর করা হয়। আর তৃতীয় পর্বে ছিল ২৫ মার্চ কালরাতের প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা।

তিনটি পর্ব শেষ হওয়ার পর ইমরান কর্মসূচি ঘোষণা করে বক্তব্য দেন। এরপর সমাবেশ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলেও মঞ্চে চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

রাত ৮টায় শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং হাতিরঝিল থেকে একযোগে ফানুস ওড়ানোর কর্মসূচি থাকলেও শাহবাগ মোড় থেকে ফানুস ওড়ানোর কর্মসূচি বাতিল করা হয়।

মঞ্চ থেকে বলা হয়, শাহবাগে প্রচুর বৈদ্যুতিক তার থাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

গত ২১ ফেব্রুয়ারির পর শাহবাগে প্রজন্ম চত্বরে এটাই ছিল প্রথম সমাবেশ। ওই সমাবেশেই জামায়াত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরু করতে সরকারকে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল।

মহাসমাবেশ বলা হলেও আগের মহাসমাবেশ থেকে মঙ্গলবারের সমাবেশে উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। শাহবাগ মোড় থেকে চারুকলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয় সমাবেশ।

দুপুর থেকেই মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে যোগ দিতে থাকে বিভিন্ন সংগঠন।

মিছিলকারীদের হাতে থাকা প্লাকার্ডগুলোতে লেখা ছিল- ‘পার্লামেন্টে বিল আন, জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ কর’/ ‘আল্টিমেটাম শেষ হল, সরকার কী করল’/ ‘জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ চাই’/ ‘ঘেরাও ঘেরাও ঘেরাও চাই’/ ‘শাহবাগের গর্জন, জামায়াত-শিবির বর্জন’ স্লোগান।

মিছিলের সামনের ব্যানারে লেখা ছিল- ‘জামায়াতের অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তদন্ত কমিশন গঠন কর, রাষ্ট্রায়ত্ত কর’।

সমাবেশ শুরুর আগে দুপুর ১টায় পাবলিক লাইব্রেরির সামনে জমায়েত হয় আন্দোলনকারী ১৯টি সংগঠন।

বিকাল ৩টায় মূলমঞ্চে সারিগান পরিবেশনের মাঝেই কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির সামনে থেকে ১৯ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যানার-প্লাকার্ড নিয়ে মঞ্চের সামনের মহাসমাবেশস্থলে আসে।

এই ১৯ সংগঠনের মধ্যে রয়েছে- জাতীয় স্বার্থে ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, গণরায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্কোয়াড, আমরা, শহীদ রুমী স্কোয়াড, জেগে আছি, বিক্ষুব্ধ নারী সমাজ, ফাঁসির মঞ্চ, মুভিয়ানা, রাস্তা, অর্বাক, ম্যাজিক মুভমেন্ট, ঘাসের কেল্লা, আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা-সর্বজন, আদিবাসী ফোরাম, সাংস্কৃতিক মঞ্চ ও তীরন্দাজ।

যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে তার ফাঁসির দাবিতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে একদল তরুণের অবস্থান কর্মসূচি দেশব্যাপী গণজাগরণের সৃষ্টি করে।

যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় না পাওয়ার ক্ষোভ থেকে সৃষ্ট এই প্রতিবাদ দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন পাওয়ার পর জাতীয় সংসদে আইন সংশোধন করে সরকার ও আসামি পক্ষের আপিলের সমান সুযোগের বিধান যোগ করা হয়।

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার গণজাগরণ মঞ্চের দাবির মুখে পরে সংশোধিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে কোনো দল বা সংগঠনের যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিধানও যোগ করা হয়।

গণজাগরণ মঞ্চ একে আন্দোলনের অর্জন হিসেবেই দেখছে। মঙ্গলবারের সমাবেশেও তা বলেন মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান।  

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ পর্যন্ত তিনজনের মামলার রায় হয়েছে, যার মধ্যে কাদের মোল্লা ছাড়া বাকি দুজন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও আবুল কালাম আজাদ (বাচ্চু রাজাকার) মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।