‘রাজীবকে খুনের পেছনে ছাত্রশিবির নেতা’

ইসলামী ছাত্রশিবিরের এক নেতার পরিকল্পনায় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয় বলে অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 March 2013, 00:30 AM
Updated : 14 August 2013, 05:44 PM

এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর শনিবার গোয়েন্দা পুলিশের এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানানো হয়েছে।

গ্রেপ্তার পাঁচজনই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- ফয়সাল বিন নাইম ওরফে দীপ (২২), মাকসুদুল হাসান অনিক (২৬), এহসান রেজা রুম্মান (২৩), নাঈম সিকদার ইরাদ (১৯) ও নাফিস ইমতিয়াজ (২২)। তারা সবাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে পড়েন।

তাদের কাছ থেকে দুটি চাপাতি, চারটি চাকু, একটি বাই সাইকেল, এক জোড়া কেডস, সাতটি বিভিন্ন ধরণের মোবাইল ফোনসেট এবং একটি স্কুল ব্যাগ উদ্ধার করা হয়।

দীপ এবং নাঈম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যাণ্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, রুম্মান এবং ইরাদ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিক্স অ্যাণ্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র। নাফিস একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র ছাত্র। 

এদের দুজন ছুরি ও চাপাতি নিয়ে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় বলে পুলিশ জানিয়েছে। বাকি তিনজন ছিলেন আশপাশেই।

গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার নজরুল ইসলামের নির্দেশনায় তাদের গ্রেপ্তারের অভিযানে অংশ নেন অতিরিক্ত উপ কমিশনার মশিউর রহমান ও মানস কুমার পোদ্দার এবং জ্যেষ্ঠ সহকারি কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম।

রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেপ্তাকৃতরা ৩/৪দিন পালিয়ে ছিলেন জানিয়ে যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, এরপর থেকে তারা নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করে।  

এই পুলিশ কর্মকর্তা আরো বলেন, শিবিরের একজন ওই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় ছিলেন বলে গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে। তাদেরকে বিভিন্ন ব্লগের ঠিকানা এবং ব্লগ থেকে ডাউনলড করে তথ্য দিয়ে প্ররোচিত করেন শিবিরের ওই ব্যক্তি।

‘পরিকল্পনাকারী’ ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেনি গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই ব্যক্তি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা।

তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে- জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, “ঈমানি দায়িত্ব পালনের জন্য এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর কথা গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তিনজন পুলিশকে বলেছে।”

তিনি বলেন, “গ্রেপ্তারকৃতদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসবাদে আরো তথ্য পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করছি।”

ব্লগার রাজীবকে হত্যার পরিকল্পনা মাসখানেক আগে করা হয় বলে গ্রেপ্তারকৃতরা পুলিশকে জানিয়েছে।

মনিরুল ইসলাম বলেন, “ফেইসবুকে রাজীবের বিভিন্ন স্ট্যাটাস দেখে তাকে ফলো করা হত। তার বাড়িতেও রেকি করেছিল তারা।” 

তিনি জানান, ওই হত্যায় জড়িত সাতজনের নাম তারা পেয়েছে। যাদের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হলো।

তিনি বলেন, “রাজিবকে হত্যার আগে তারা ‘ইনটেল গ্রুপ’ এবং ‘এক্সিকিউশন গ্রুপ’ নামে দুটি গ্রুপ গঠন করে। একটি গ্রুপ তথ্য দেয় এবং অপরটি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়।”

এই পাঁচ ছাত্রকে শুক্রবার রাত থেকে সকাল পর্যন্ত খিলগাঁও, কাকরাইল, বারিধারা ও পান্থপথে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।

ফয়সালের বাসা ঢাকার মাতুয়াইলে, মাকসুদ থাকেন কেরানীগঞ্জে। রুম্মানের বাড়ি ঝিনাইদহে, নাঈমের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবং নাফিসের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। 

পুলিশের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম আরো জানান, অনিক অথনৈতিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। সে বাড্ডা বাজার থেকে তিন হাজার টাকায় চাপাতি চাকু কিনে। ঘটনার দিন বিকাল ৪টায় তারা রাজীবের বাসার গলিতে অবস্থান নেয়। এরপর তারা সেখানে লোক দেখানো ক্রিকেট খেলে।

রাজীব গলিতে আসলে ‘এক্সিকিউশন গ্রুপ’এর সদস্য দীপ চাপাতি দিয়ে ঘাড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করার  উদ্দেশ্যে ঘাড়ে কোপ দেয়। এতে রাজীব পড়ে গেলে একই গ্রুপরে সদস্য অনিক তার হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে।

পরে তারা দৌড়ে পালিয়ে যায়। এসময় নিজেদের চাকুর আঘাতে হত্যাকাণ্ডে অংগ্র নেওয়া ইরাদ আহত হয়।    

শাহবাগ আন্দোলন শুরুর ১০ দিনের মাথায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরের বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় স্থপতি রাজীবকে।

রাজীব ব্লগে লেখালেখি করতেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে লেখালেখির কারণেই জামায়াত-শিবির রাজীবকে হত্যা করেছে বলে তার সহযোদ্ধা ও স্বজনদের অভিযোগ।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে দেশব্যাপী গণজাগরণ আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে রাজীবকে অভিহিত করা হচ্ছে।

রাজীব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার বাবা মামলা করেছেন, ডিবি তা তদন্ত করছে।

রাজীবের লাশের পাশে থাকা ল্যাপটপে রক্তের ছোপ ছিল এবং হাতে লেগে ছিল কিছু চুল।

ধারণা করা হচ্ছে, ওই চুল হত্যাকারীর। হত্যাকাণ্ডের সময় রাজীব বাঁচতে খুনির চুল ধরেছিল।

এ বিষয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, চাপাতি দিয়ে আঘাত করার ফলে রাজীবের চুলও কাটা যায়। ওই চুল রাজীবেরও হতে পারে। তবে পরীক্ষা করলেই জানা যাবে।

জমে থাকা ওই রক্ত এবং চুলের ডিএনএ পরীক্ষার আদেশ দিয়েছে আদালত। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধানকে ওই দুটি আলামতের ডিএনএ পরীক্ষার পর তা তদন্ত কর্মকর্তাকে দিতে বলা হয়েছে।