জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচারের পথ খুলল

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির পাশাপাশি দল বা সংগঠনের বিচারের সুযোগ রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধনের বিল পাস করেছে জাতীয় সংসদ। 

মঈনুল হক চৌধুরীসুমন মাহবুব ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2013, 04:30 AM
Updated : 17 Feb 2013, 07:33 AM

একইসঙ্গে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আসামির পাশাপাশি সরকারেরও আপিলের সমান সুযোগ রাখা হয়েছে সংশোধিত আইনে।

এর মধ্য দিয়ে একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের বিচার করার পাশাপাশি দলটির নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার সাজা বাড়ানোর জন্য আপিল করার পথ তৈরি হলো।    

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন মহাজোটের প্রায় সব সদস্যের উপস্থিতিতে রোববার সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল)(সংশোধন) ২০১৩। এ সংসদের একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম এ সময় অধিবেশনে ছিলেন না।

রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকেই এ আইন প্রযোজ্য হবে।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে টানা ১৩ দিন ধরে চলমান আন্দালনের অন্যতম উদ্যোক্তা ইমরান এইচ সরকার আইন সংশোধনের এ বিষয়টিকে ‘প্রাথমিক বিজয়’ হিসাবে দেখছেন। তাদের সাত দফা দাবির মধ্যে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিও রয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত দেয়া দুটি রায়ের পর্যবেক্ষণেও একাত্তরে দল হিসাবে জামায়াতের সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো উঠে এসেছে।  

গত ৫ ফেব্রুয়ারি  ট্রাইব্যুনাল হত্যা ও ধর্ষণের মতো অপরাধে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার আদেশ দেয়ার পর সাজা বাড়াতে আপিল করার সুযোগ না থাকার বিষয়টি উঠে আসে। মুক্তিযোদ্ধা ও বামদলগুলোসহ বিভিন্ন মহল থেকে এই রায়ে হতাশা প্রকাশ করে আইন সংশোধনের দাবি ওঠে।

কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের ডাকে ওইদিন সন্ধ্যা থেকেই শাহবাগে শুরু হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলন, যা পরে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। গত দুটি শুক্রবার শাহবাগের সঙ্গে সারা দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার শপথ নেয়। জাতীয় সংসদও এর সঙ্গে একাত্মতা জানায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ ফেব্রুয়ারি সংসদে বলেন, তিনি এই আন্দোলনের শপথের প্রতিটি বাক্যের সঙ্গে একমত এবং তাদের এই শপথ বাস্তবায়নের জন্য যা যা দরকার সবই করা হবে।

ফাঁসির দাবিতে এই বিপুল জাগরণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের পর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিল তোলা হয় সংসদে। একদিনের মধ্যে বিলটি যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য পাঠানো হয় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে।

জামায়াতের বিচার

স্থায়ী কমিটির অনুমোদন শেষে আইন মন্ত্রী শফিক আহমেদ রোববার বিলটি পসের জন্য সংসদে উত্থাপন করেন। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এই বিলে দুটি সংশোধনীর প্রস্তাব দেন।

ট্রইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণের বিষয়টি এনে মেনন বলেন, “ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনকে বিচারের পাশাপাশি নিয়ে আসা প্রয়োজন। বাচ্চু রাজাকারের রায়ে বলা হয়েছিল, জামায়াত কীভাবে অপকর্মে সংযুক্ত ছিল।”

মেননের বক্তব্যের পর আইন মন্ত্রীকে বক্তব্য দেওয়া আহবান জানিয়ে স্পিকার আব্দুল হামিদ বলেন, সংবিধানে ৪৭এর (৩ ) অনুচ্ছেদ থেকে উদ্ধৃত করেন।

ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়, “এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোনো সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য বা অন্য কোনো ব্যক্তি, ব্যক্তি সমষ্টি বা সংগঠন কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারীতে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করিবার বিধান-সংবলিত কোনো আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবে না কিংবা কখনও বাতিল বা  বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না ।”

মেনন তার প্রথম সংশোধনীতে ৩(১) উপধারায় ‘individuals’ শব্দটির পর ‘or organization’  যোগ করার কথা বলেন।

আইন মন্ত্রী বলেন, “দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নাৎসিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিলো।মাননীয় সাংসদ সদস্য যে সংশোধনী প্রস্তাব রেখেন তা গ্রহণ করা যায়।”

এরপর রাশেদ খান মেননের সংশোধনী প্রস্তাবসহ কণ্ঠভোটে পাস হয় বিলটি।

জামায়াত যে যুদ্ধাপরাধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল- তা উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়েও।

কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শুক্রবার শাহবাগে জাগরণ সমাবেশ।

জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী একাত্তরে ‘পাকিস্তান রক্ষার’ নামে ‘সশস্ত্র বাহিনী’ তৈরির মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করে।

“যে নিপীড়ন ও নির্যাতন সয়ে, যে রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে নিরস্ত্র বাঙালিকে একাত্তরে মুক্তি অর্জন করতে হয়েছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সেই সময়ের বিশ্ব ইতিহাসে আর কোনো জাতিকে বোধ হয় লক্ষ্য অর্জনে এতোটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি।”

আর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সহযোগী বাহিনী লেলিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণের বিষয়ে আরো বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয় ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় রায়ের পর্যবেক্ষণে। এই রায়ে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা হয়।

জামায়াত এবং এর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, গুটিকতক বাঙালি, বিহারী, অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী এবং কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ, মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজাম-ই-ইসলামী স্বাধীন বাংলাদেশের ধারণা বর্বরভাবে প্রতিরোধ করতে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল অথবা সহযোগিতা করেছিল।

“আর তাদের অধিকাংশ বাংলাদেশের সীমানায় প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনে বর্বর কর্মকাণ্ড সংগঠনে নিবেদিত হয়েছিল এবং সহায়তা করেছিল।”

রাজাকার-আলবদরের মতো সহযোগী বাহিনীর সঙ্গে জামায়াতের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে রায়ে বলা হয়, “পাকিস্তান রক্ষার নামে নিরস্ত্র বেসামরিক বাঙালি নিধনের জন্য এই সমস্ত আধা-সামরিক বাহিনী (সহযোগী বাহিনী) গঠনে জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।”

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের মহাসমাবেশে হাজারো ছাত্র-জনতা।

আপিলের সমান সুযোগ

উত্থাপতি বিলে বলা হয়েছিল, ট্রাইবুনালের বিচারের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ বা দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির পাশাপাশি যে কোনো ‘সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিও’ আপিল করতে পারবে। এতে জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে কমিটি ‘সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি’ কথাটি বাদ দেয়।

সংশোধিত আইনের ২১(৪) উপধারায় বলা হয়েছে, আপিল দায়েরের ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করতে হবে।

আইনের ২১(১) উপ ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনে কোনো অভিযুক্তকে সাজা দেওয়া হলে তিনি আপিল করতে পারবেন।

একইভাবে সরকার বা অভিযোগকারী বা এজাহারকারীও রায়ের বা শাস্তির আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে বলে সংশোধিত আইনের ২১(২) উপধারায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এ আইনের ২১(১) ও ২১(২) উপধারা অনুযায়ী দণ্ডাদেশের বা খালাসের বিরুদ্ধে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করা যাবে। এই সময়ের পর আপিলের সুযোগ থাকবে না।

১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনে সরকারের আপিলের কোনো সুযোগ ছিল না। ২০০৯ সালে আইন সংশোধনের পর সরকার পক্ষের আপিলের সুযোগ রাখা হয়, তবে তা ছিল শুধু খালাসের রায়ের ক্ষেত্রে।