‘এই লড়াইয়ে জিততে হবে’

হাজারো মোমবাতি জ্বালিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আরো জোরালো করে তুললো শাহবাগ, যেখানে কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে টানা পঞ্চমদিনের মতো চলছে বিক্ষোভ।

আশিক হোসেন নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Feb 2013, 11:22 AM
Updated : 9 Feb 2013, 09:54 PM

শনিবার সন্ধ্যায় আগের দিনের মতোই জনসমুদ্র হয়ে ওঠে রাজধানীর শাহবাগ চত্বর। সাগরের ঢেউয়ের মতো স্লোগানের গর্জন পুরো এলাকায়।

জাতীয় জাদুঘর থেকে চারুকলার সামনে, শাহবাগ চত্বর থেকে কাঁটাবনের রাস্তায় লাখো কণ্ঠে একটাই স্লোগান- যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ কর, করতে হবে। হাজার হাজার মোমবাতির মিটমিট আলোও যেন দুলে দুলে দিচ্ছে স্লোগান।  

আগের দিনের ক্লান্তি নিয়ে যারা বিশ্রামে গিয়েছিলেন তারাও এসে যোগ দেন বিকেল থেকে।

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে এই শাহবাগে চার দিন ধরে অবস্থান চালিয়ে আসার পর শুক্রবার বিকালে মহাসমাবেশ থেকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত রাজপথে সোচ্চার থাকার শপথ নেয় লাখো জনতা।

জামায়াত যে যুদ্ধাপরাধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল- তা উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত দেয়া দুটি রায়েও।

এর মধ্যে একটি রায়ে জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির রায় হয়েছে। আর দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

কিন্তু দ্বিতীয় রায়ে অসন্তুষ্ট মানুষ কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে মঙ্গলবার থেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছে শাহবাগে।

শুক্রবার লাখো মানুষের সমাগমের পর শনিবার পঞ্চম দিনেও সেখানে ছিল একই চিত্র।

বিক্ষোভে অংশ নেয়া তরুণ-যুবারা এদিন বিভিন্ন স্থানে গোল হয়ে বসে মাইকে ভেসে আসা স্লোগানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে যুগিয়েছেন অনুপ্রেরণা, সাহস আর জানিয়েছেন রাজপথ না ছাড়ার শপথে সহমত।

দীর্ঘ এলাকাজুড়ে প্রায় প্রত্যেকের হাতেই দেখা গেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড, মাথায় ব্যান্ড আর জাতীয় পতাকা।

বিকালে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সংহতি জানান তরুণদের এই আন্দোলনে।

এ সময় তিনি কোন বক্তব্য না রাখলেও ঘোষণা মঞ্চ থেকে জানানো হয়, ‘মতিয়া আপা আমাদের মধ্যে এসেছেন। আমরা তার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে চাই, ‍রাজাকারদের ফাঁসি ছাড়া আমরা ঘরে ফিরবো না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রয়োজনে আইনের ধারা পরিবর্তন করতে হবে।”

এ সময় সবাই স্লোগান দিতে শুরু করেন, ‘কুকুর বেড়াল মেরো না/ জামায়াত-শিবির ছেড়ো না’, ‘জামায়াত শিবির যেখানে/ প্রতিরোধ সেখানে’, ‘ধর্মভিত্তিক রাজনীতি/ নিষিদ্ধ কর, করতে হবে’।

এর আগে দিনের আলো ফোঁটার পর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল এসে জড়ো হয় বিক্ষোভের কেন্দ্রস্থল শাহবাগে। একেকটা মিছিল এসে পৌঁছামাত্র বিক্ষোভের মঞ্চ থেকে স্লোগান আর করতালির মাধ্যমে অভিবাদন জানানো হয় তাদের।

আগের দিনগুলোর মতো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায় থেকে এই আন্দোলনে সংহতি জানোনো হচ্ছে, যা সাহস আরো বাড়িয়ে তুলছে বলে আন্দোলনকারীরা বলছেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় না নিয়ে তাই ঘরে ফিরবেন না বলেও জানাচ্ছেন তারা।

টানা পাঁচ দিন ধরে স্লোগান দিয়ে যাওয়া মুক্তা বাড়ৈ সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির যে দাবি আমরা তুলেছি, তা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরব না।”

ইডেন কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থীর মতো অনেকেই পুরোটা সময় শাহবাগেই থাকছেন। খাওয়া-দাওয়াও হচ্ছে সেখানেই।

প্রথম দিন থেকেই আন্দোলনে থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শফিক এম রহমান বলেন, “শাহবাগ থেকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা থামবে না। প্রত্যেকটা রাজাকারের ফাঁসির রায় নিয়ে তবেই আমরা রাজপথ ছেড়ে ঘরে ফিরব।”

‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু’ সুর তুলে তিনি বলেন, “দৈহিক ক্লান্তি মাঝে মাঝে অনুভব করি, কিন্তু অক্লান্ত মন তাতে সায় দেয় না। সবার অংশগ্রহণ দেখে ক্লান্তি কেটে যায়।”

শফিক জানান, মাঝে মাঝে একটু সময়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে যান তিনি। এছাড়া অনেকেই রয়েছেন, যারা মাঝে কোনো কাজ সেরে পুনরায় ফিরে আসছেন ‘প্রজন্ম চত্বরে’।

দুপুরের পরেই শাহবাগ পরিণত হয় জনসমুদ্রে। বিক্ষোভের মূল মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি এবং জামায়াত-শিবির প্রতিহত করার আহ্বান জানানো হয়।

এক সময় মূল মঞ্চ থেকে জানানো হয়, ‘বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে’। তাই দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ডগুলো বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও লেখার আহ্বান জানানো হয়।

সকালে বিক্ষোভে সংহতি জানান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের দুই সন্তান নিতু ও মিশু, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আযাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষাথী, মহেশখালী স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সংগঠন।

রাজধানীর বাহিরের বিভিন্ন এলাকা থেকে নতুন করে অনেকে এসেছেন বিক্ষোভে।

এদেরই একজন রিয়াদ আহমেদ এসেছেন কুমিল্লা থেকে। তিনি বলেন, “বিভিন্ন কারণে এতদিন আসতে পারিনি। কিন্তু আজ আর ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। তাই সকালেই ছুটে এসেছি দাবির প্রতি নিজের সমর্থন জানাতে।”

আজকে এই গণজাগরণ দেখে মনে হচ্ছে আমি এক নিমিষেই যেন পুরো বাংলাদেশ দেখে ফেললাম। এই লড়াইয়ে জিততেই হবে,” দীপ্ত কণ্ঠে বলছিলেন রিয়াদ।”