‘ফাঁসি চাই’ দাবিতে শাহবাগে অবস্থান অব্যাহত

আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা প্রত্যাখ্যান করে এই জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে।

সুলাইমান নিলয় আশিক হোসেন ও সুজন মণ্ডলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Feb 2013, 06:12 AM
Updated : 5 Feb 2013, 01:17 PM

‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে এই জনতা’ এই গানের পাশাপাশি স্লোগান-কবিতা-চলচ্চিত্র-বক্তৃতায় মঙ্গলবার বিকালে কয়েকশ তরুণের প্রতিবাদী এই কর্মসূচি রাত গড়াতেই হাজার-হাজার মানুষের সমাবেশে পরিণত হয়েছে।

শাহবাগ চৌরাস্তা ঘিরে অবস্থান নেয়া এই প্রতিবাদী কর্মসূচির উদ্যোক্তারা বলছেন, সারারাত এমনকি দাবি না মানা পর্যন্ত তারা অবস্থান ছাড়বেন না।

সমাবেশে সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা সংহতি প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, তরুণ প্রজন্মের এই দাবিতে তারাও একাত্ম।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সংহতি জানিয়ে বলেন, “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এখান থেকে ৫০০ গজ দূরে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে উঠা জনতার আদালতে কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছিল।

কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় চেয়ে শাহবাগে তরুণদের অবস্থান, যাতে সংগতি জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন।

“আজ কেন যাবজ্জীবন হল। আমি এই রায় মানি না। আমরা এই রায় মানি না। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মানি না, মন্ত্রী হই আর যাই হই।”

সংহতি জানিয়ে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, একই দাবিতে তারা বুধবার তারা শহীদ মিনার থেকে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত সড়কজুড়ে কর্মসূচি পালন করবেন তারা।

যুদ্ধাপরাধের মামলায় মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।

এই রায়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ এই বিচারের দাবি জানিয়ে আসা দল ও সংগঠনগুলো অসন্তোষ প্রকাশ করে।

রায় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর বিকাল ৫টার দিকে কাদের মোল্লার ফাঁসি চেয়ে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন হয়।

এই মানববন্ধনের খবর ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণরা আসতে থাকলে উত্তাল হয়ে উঠে সমাবেশ।

শাহবাগ ‘অবরোধের’ উদ্যোক্তা ‘ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক’র সদস্য মাহমুদুল হক মুন্সি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালতের এ রায় আমরা মানি না। আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত ঘরে ফিরব না, যতক্ষণ না কাদের মোল্লার ফাঁসির সাজা হবে।”

“এ রায়ের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের রক্তের সাথে বেঈমানি করা হয়েছে। কাদের মোল্লা হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে সবাই জানে, এটা তো প্রমাণ হয়েছে। তাহলে তাকে লঘু দণ্ড দিয়ে বিচারের নামে প্রহসন কেন?”

প্রথমে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে করার কথা থাকলেও সবার ইচ্ছায় রাস্তা অবরোধ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

অবরোধকারীদের আরেকজন ইমরান এইচ সরকার বলেন, “প্রয়োজনে আমরা শাহবাগে রাতভর অবরোধ করব। কিন্তু কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় নিয়ে ঘরে ফিরব।”

কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সন্ধ্যার পর স্লোগান-৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মশাল মিছিল বের করে। এ সব মশাল মিছিল ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শাহবাগে এসে যোগ হয়।

আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় চেয়ে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি।

সলিল চৌধুরীর সুর করা কালজয়ী গণসঙ্গীত ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা’-  সন্ধ্যা থেকে এই গানটিই বেশ কয়েকবার গাওয়া হয় বিক্ষোভে উত্তাল শাহবাগ থেকে, যে গানটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও প্রেরণা যোগাত।

গানের পাশাপাশি স্লোগান উঠে- ‘কোন আঁতাতে এমন রায়/দেশের মানুষ জানতে চায়’, ‘মেহেরুন্নেসা ক্ষমা চাই/ফাঁসির কোনো বিকল্প নাই’, ‘ট্রাইব্যুনালের ছাড় নাই/কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই’, ‘এমন রায়ে কাঁদছে চোখ/আমার না হয় ফাঁসি হোক’ ইত্যাদি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের উদ্যোগে বড় পর্দা বসিয়ে সেখানে প্রদর্শিত হয়েছে ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘মুক্তির গান’, ‘আগুনের পরশমনি’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র।

চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, অবস্থান কর্মসূচি যতক্ষণ চলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক  চলচ্চিত্র দেখিয়ে যাবেন।

চারুকলার শিক্ষার্থীরা লম্বা লম্বা সাদা কাপড়ে রাজাকারের ব্যাঙ্গচিত্র এঁকেছেন। এছাড়া কাদের মোল্লার একটি কুশপুত্তলিকা নিয়ে আসা হয়েছে মোড়ে।

রাতের খাবারের জন্য সমাবেশে টাকা তুলে টাকা খিচুড়ি রান্নার ব্যবস্থাও হচ্ছে।

সন্ধ্যা থেকে এই সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সিপিবির সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান খান, বর্তমান সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, গণফোরামের পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য, হিমালয়জয়ী প্রথম বাংলাদেশি মুসা ইব্রাহিম, ছাত্রলীগ সভাপতি বদিউজ্জমান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এসএম শুভ প্রমুখ।

শিল্পী অরুপ রাহী, কফিল আহমেদ, কামাল পাশাও এতে সংহতি জানিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকদের ব্যানারে একদল শিক্ষক এই অবস্থান কর্মসূচিতে এসে সংহতি প্রকাশ করেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন- আ ব ম ফারুক, শেখ আব্দুস সালাম, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, শান্তনু মজুমদার, শফিউল আলম ভূঁইয়া, ফাহমিদুল হক, মফিজুর রহমান, মাহমুদ হাসান প্রমুখ।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, “এই রায়ের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, বরং দেশের মানুষ হতাশ হয়েছে।”

উচ্চ আদালতে আপিলের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশিত সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।

মনজুরুল আহসান খান ৪১ বছর পর ‘স্বাধীনতার নতুন সংগ্রামে’ সবাইকে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “এই বিচারের সবাই দেখে দুটি পক্ষ। প্রসিকিউশন ও আসামি পক্ষ।

“কিন্তু এখানে আরেকটি পক্ষ রয়েছে, ৩০ লাখ শহীদের পক্ষ। ন্যায়বিচারের জন্য আজ তাদের আত্মা কেঁদে উঠেছে। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের অবশিষ্ট অর্জনও শেষ হয়ে যাবে।”

“আমি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছি। আগামীকাল আমরা শহীদ মিনার থেকে বাহাদুর পার্ক পর্যন্ত এলাকায় বিক্ষোভ করব। আমরা প্রমাণ করব, দেশের ৯৫ ভাগ মানুষ রাজাকারদের ফাঁসি চায়,” বলেন সিপিবি সভাপতি।

এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়া তরুণদের এই প্রজন্মের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলে অভিহিত করেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য।