কাদেরের যুদ্ধাপরাধ: দুটিতে প্রত্যক্ষ, সংশ্লিষ্ট তিনটিতে  

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের কারণে ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিত জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ছয়টি অভিযোগের একটিতে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে পারেনি প্রসিকিউশন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Feb 2013, 04:54 AM
Updated : 5 Feb 2013, 07:31 AM

অপর পাঁচ অভিযোগের তিনটিতে সংশ্লিষ্টতা এবং দুটিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে।

আর এর ভিত্তিতেই মঙ্গলবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে এই যুদ্ধাপরাধীকে।   

একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, ষড়যন্ত্র, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ওই ছয় ঘটনায় অভিযোগ গঠনের পর গত বছরের ২০ জুন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের যে ছয় ঘটনায় কাদের মোল্লার জড়িত থাকার অভিযোগে বিচার হয় এই জামায়াত নেতার।

পল্লবসহ সাত জনকে হত্যা

একাত্তরে মিরপুর-১১ নম্বরের বি-ব্লকের বাসিন্দা ও মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব স্থানীয় বাঙ্গালি ও অবাঙ্গালিদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন। ১৯৭১ সালের মার্চে ‘স্বাধীনতাবিরোধীরা’ পল্লবকে নবাবপুর থেকে ধরে মিরপুরে কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে যায়।

কাদের মোল্লার নির্দেশে পল্লবকে হাতে দড়ি বেঁধে টেনেহিঁচড়ে মিরপুর-১২ নম্বর থেকে ১ নম্বর সেকশনে শাহ আলী মাজার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে মিরপুর-১ নম্বর থেকে ১২ নম্বর সেকশনে ঈদগাহ মাঠে নেয়া হয় একইভাবে।

পরে পল্লবকে গাছে ঝুলিয়ে আঙুল কেটে দেওয়া হয়। দুদিন পর গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে।

হত্যার দুদিন পর পল্লবের লাশ মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে কালাপানি ঝিলের পাশে আরও ছয় জনের সঙ্গে মাটি চাপা দেওয়া হয় বলে উল্লেখস করেছে প্রসিকিউশন।

রায়ে বলা হয়, এ ঘটনায় কাদের মোল্লার প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত না হলেও তার  সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে।

কবি মেহেরুন্নেসা ও তার মা-ভাইকে হত্যা

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সকাল ১১টায় আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর একটি দল কবি মেহেরুন্নেসার মিরপুরের বাসায় যায়। কাদের মোল্লার নির্দেশে সেখানেই মেহেরুন্নেসাকে জবাই করে তারা।

শরীর থেকে মাথা কেটে রশি দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয় মেহেরুন্নেসার লাশ। জবাই করা হয় কবির দুই ভাই রফিকুল হক বাবলু, শরিফুল হক টুকু এবং তাদের মাকেও।

ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছে, কবি মেহেরুন্নেসা ও তার মা-ভাইকে হত্যার ঘটনায় কাদের মোল্লার ‘সংশ্লিষ্টতা’ প্রমাণিত হয়েছে।

খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর পালিয়ে আরামবাগে চলে যান মিরপুর ১০ নম্বরের বাসিন্দা খন্দকার আবু তালেব। ২৯ মার্চ তিনি মিরপুরে ফিরে দেখতে পান, সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

এরপর আরামবাগে ফেরার জন্য মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে গেলে আব্দুল কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা রশি দিয়ে বেঁধে আবু তালেবকে জল্লাদখানা পাম্প হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে তাকে জবাই করা হয়েছিল বলে মামলায় অভিযোগ ছিল।

এ ঘটনায়ও কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।

পল্লবকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ, কবি মেহেরুননিসা, তার মা এবং দুই ভাইকে হত্যা এবং সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে জবাইয়ের এই তিন ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার কারণে কাদের মোল্লার ১৫ বছর করে কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

দুই ঘটনায় যাবজ্জীবন

মিরপুরের আলোকদী গ্রামে গণহত্যা এবং অন্য এক ঘটনায় হযরত আলী লস্করকে তার স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা এবং লস্করের মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

আলকদী গ্রামে গণহত্যার অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৪ এপ্রিল ফজরের নামাজের সময় পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারে করে তুরাগ নদীর পাড়ে পল্লবীর আলকদী গ্রামের পশ্চিম পাশে অবতরণ করে। সে সময় কাদের মোল্লার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর প্রায় ৫০ জন সদস্য ও কয়েকজন বিহারী ওই গ্রাম ঘিরে ফেলে।

এরপর নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। এই অভিযানে ৩৪৪ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছিল প্রসিকিউশনের অভিযোগে।

হযরত আলী ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা, ধর্ষণের অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, কাদের মোল্লা ও বিহারী আক্তার গুণ্ডাসহ কয়েকজন বিহারী একাত্তরের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৬টার দিকে মিরপুরের শহীদ হযরত আলী লস্করের বাড়িতে হানা দেয়। তারা জোর করে ওই বাড়িতে ঢুকে হজরত আলীকে গুলি করে, তার অন্তসত্ত্বা স্ত্রী আমিনা ও দুই মেয়েকে (বয়স ৭ ও ৯ বছর) জবাই করে হত্যা করে।

এরপর আলীর দুই বছরের ছেলে বাবুকে মাটিতে আছড়ে হত্যা করে কাদের মোল্লার সহযোগীরা।

এসব দেখে চৌকির নিচে লুকিয়ে থাকা হযরত আলীর আরেক মেয়ে চিৎকার করে উঠলে তাকে সেখান থেকে টেনে বের করে পলাক্রমে ধর্ষণ করা হয়।

খানবাড়ি ও ঘাটারচরে গণহত্যা

কেরানীগঞ্জের ভাওয়াল খানবাড়ি এবং ঘাটারচরে শতাধিক গ্রামবাসীকে হত্যার ঘটনায় কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি।

এই দুই ঘটনায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর সকালে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে কেরানীগঞ্জের খানবাড়ি ও ঘটারচর এলাকার দুটি গ্রামে হামলা করে ৪২ জনকে হত্যা এবং বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া হয়েছিল।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গত বছরের ১ নভেম্বর জমা দেয়া হয় তদন্ত প্রতিবেদন। ২৮ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ গঠনের আদেশে কাদের মোল্লার পরিচিতিতে বলা হয়, ১৯৪৮ সালে ফরিদপুরের আমিরাবাদ গ্রামে কাদের মোল্লা জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি ছাত্রসংঘে যোগ দেন। একাত্তরে তিনি ছাত্রসংঘের সদস্যদের দিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করেছিলেন।

মিরপুরের কসাই কাদের

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু হয় ২০১০ সালের ২১ জুলাই। একই বছরের ২ আগস্ট কাদের মোল্লাকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর তদন্ত শেষ হয়। ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনে। এরপর ২৮ মে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে কাদের মোল্লার আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল।

একাত্তরে হত্যা, খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনায় জড়িত থাকার কারণে সে সময় থেকেই জামায়াতের এই নেতা পরিচিত হয়ে ওঠেন কসাই কাদের নামে।