আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন উদ্ধৃত করে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেছেন, দণ্ড কমাতে আসামির আপিলের সুযোগ থাকলেও সাজার মাত্রা বাড়াতে আপিলের সুযোগ নেই।
তবে তার এই বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করেছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান।
আপিল করা হবে- একথা জানিয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেবে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বিভাগ।
অন্যদিকে রায়ের পর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটারদের পাশে রেখে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, আপিলের বিষয়ে সরকার পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে সিদ্ধান্ত নেবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার তাদের দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ষাটোর্ধ্ব কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়।
তার বিরুদ্ধে আনা ছয়টি অভিযোগের পাঁচটি প্রমাণিত হওয়ায় এই সাজা দেয়া হয় বলে রায়ের বলা হয়, যে রায়ে অসন্তোষ জানিয়েছে সাক্ষীসহ এই বিচার শুরুর দাবিতে আন্দোলনকারীরা।
একাত্তরে হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত জামায়াত নেতার সাজা বাড়াতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের দাবিও তুলেছেন রায়ে অসন্তোষ প্রকাশকারীরা।
আপিলের বিষয়ে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ একাত্তরে টেলিভিশনে অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সেকশন ২১ তুলে ধরে বলেন, সাজা বাড়াতে আপিলের সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত ব্যক্তি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। আর খালাস পেলে সরকার তার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে।
“যেহেতু এখানে আসামি দণ্ড পেয়েছে, সেহেতু এক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের আপিলের সুযোগ নেই। আপিল করতে পারবেন কাদের মোল্লা।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (সংশোধিত) আইনের সেকশন ২১ এ বলা হয়েছে, ৩ নম্বর সেকশনে উল্লেখিত যে কোনো অপরাধে দোষী একজন ব্যক্তি এবং ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডিত একজন ব্যক্তি যে কোনো সাজা ও দণ্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিলের অধিকার রাখে।
“খালাসের আদেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সরকারের আপিলের অধিকার রয়েছে।”
আপিল বিভাগে এই আপিল করতে হবে রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে।
তবে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান আপিলের ক্ষেত্রে ছয়টি অভিযোগের মধ্যে একটি থেকে কাদের মোল্লার খালাস পাওয়াকে ভিত্তি ধরছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ট্রাইব্যুনাল সব কিছু বিচার-বিবেচনা করে রায় দিয়েছে বলে আমরা মনে করি।
“তবে ৪ নম্বর অভিযোগ থেকে আসামি খালাস পেয়েছে। এই খালাসের বিরুদ্ধেই কেবল আমরা আপিল করতে পারব বলে আমি মনে করি।”
তিনি বলেন, “আইনে বলা হয়েছে, খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে। সেটা এক অভিযোগও হতে পারে, আবার পূর্ণ খালাসও হতে পারে।”
রায়ের পর আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “এ রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। জণগণ অন্য কিছু আশা করেছিল। আমরা হতাশ হয়েছি।”
রায়ে অনেকের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি স্বীকার করে সরকারের এই আইন কর্মকর্তা বলেন, “এখন রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর আমরা এ বিষয়টি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করব।
“এরপর আমরা আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। আপিলে এটা নিয়ে যুক্তিতর্কে আমরা তার সর্বোচ্চ শাস্তিই (মৃত্যুদণ্ড) চাইব।”
তবে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “প্রসিকিউশন দল যদি মনে করে, তাহলে আপিল করতে পারে। সেটা তাদের মতামতের ওপর নির্ভর করে।”
“ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনভাবে কাজ করে,” বলেন তিনি।
আপিলের বিষয়ে শফিক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “যে অভিযোগে তিনি খালাস পেয়েছেন, সেই অভিযোগের বিষয়ে প্রসিকিউশন চাইলে আপিল করতে পারে। আর একবার আপিল হলে তখন তো পুরো রায় নিয়েই যুক্তিতর্ক হবে।
“যুক্তিতর্কে বাকি অভিযোগগুলোতেও যদি আপিল বিভাগ মনে করেন, তাহলে নতুন রায় দিতে পারেন।”
তুরিন আফরোজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অ্যাটর্নি জেনারেলরা বলছেন যে, আপিল করা যাবে। তবে সার্বিকভাবে তো তাকে ট্রাইব্যুনাল তাকে দণ্ড দিয়েছে। তাই শাস্তি বাড়াতে প্রসিকিউশন আপিল করতে পারবেন না।”
আইনমন্ত্রীর বক্তব্য জানানোর পর তিনি বলেন, “যে অভিযোগে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে, খালাস বলতে যদি সেটা বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে মনে হয় আপিল করা যেতে পারে।
“তবে এক্ষেত্রেও আপিল বিভাগে তারা অন্য অভিযোগের শাস্তি বাড়াতে বলতে পারবে না।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিকও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, খালাস পাওয়া অভিযোগে প্রসিকিউশন আপিল করতে পারবে।
একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেন, “মনে করেন, একজনের বিরুদ্ধে চুরি, ডাকাতি ও ধর্ষণের অভিযোগ আনা হল। বিচারিক আদালতের মনে হয়েছে, আসামির বিরুদ্ধে চুরি ও ডাকাতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তাহলে কি ধর্ষণের বিষয়ে বিচার চেয়ে আপিল করা যাবে না?”
এদিকে যাবজ্জীবন সাজার বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন কাদের মোল্লার আইনজীবীরা।
আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে অবশ্যই আপিল করব।”