‘বাচ্চু রাজাকারের’ রায় সোমবার

একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ ছয় ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের আটটি ঘটনায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে মামলার রায় হবে সোমবার।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2013, 11:24 PM
Updated : 20 Jan 2013, 12:45 PM

যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই প্রথম কোনো মামলার রায় হতে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহামুদ রোববার সাংবাদিকদের রায়ের এ তারিখ জানান।

তিনি বলেন, “ মামলার বিচার কাজ শেষে যুক্তি-তর্কের শুনানি করে ট্রাইব্যুনাল মামলাটির রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমান রেখেছিল। আগামীকাল আবুল কালাম আযাদের মামলাটির  রায় ঘোষণার জন্য কার্যতালিকায় থাকবে।

“এই বিবেচনায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক দিন।”

ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু বলেন, “গভীর প্রত্যাশা নিয়ে অধীর আগ্রহ ভরে জাতি এ রায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের বিশ্বাস, সোমবার মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত রায় ঘোষণা করা হবে।”

আবুল কালাম আযাদ মামলার শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন। তার অনুপস্থিতিতেই বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ গত ২৬ ডিসেম্বর মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন গত বছর ২ সেপ্টেম্বর আযাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে, যাতে জোর করে ধর্মান্তরিত করা, দেশত্যাগে বাধ্য করা, লুট, ধর্ষণ, হত্যা, গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়।

এতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র আযাদ ছাত্রসংঘের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২৫ মার্চের কালরাতের পর তিনি সহযোগীদের নিয়ে ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান।

গত এপ্রিলে আযাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলেও পুলিশ তার বাসা ও অফিসে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়। এরপর ট্রাইব্যুনাল গত ৯ সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আমলে নিয়ে ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করতে বলে।

আযাদ পলাতক থাকায় এবং বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও হাজির না হওয়ায় গত ৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল তার অনুপস্থিতিতেই মামলার কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়।

এরপর ৪ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। আযাদের বিরুদ্ধে ৬ ধরনের ৮টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগ গঠনের আদেশে বলা হয়, ১৯৪৭ সালের ৫ মার্চ ফরিদপুরের বড়খাড়দিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আবুল কালাম আযাদ রাজেন্দ্র কলেজে লেখাপড়া করেন।

তিনি জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদেরও বিচার চলছে। 

প্রসিকিউশনের অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে রাজাকার বাহিনী গঠনের আগ পর্যন্ত আযাদ পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেন।

১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল তিনি ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে একত্র হয়ে’ ফরিদপুরে পাকিস্তানি সেনাদের ‘অভ্যর্থনা’ জানান। আযাদ স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন এবং আলবদর বাহিনীরও প্রধান ছিলেন।

পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে আযাদ স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় ও স্বাধীনতার পক্ষের বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর নৃশংস নির্যাতন চালান বলে অভিযোগ গঠনের আদেশে উল্লেখ করা হয়। 

আযাদের ‘যুদ্ধাপরাধ’

জামায়াতের সাবেক এই রুকনের বিরুদ্ধে আনা আট অভিযোগের মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও অষ্টম অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধকালে অপহরণ, আটকে রাখা ও নির্যাতনের কথা বলা হয়েছে।

প্রথম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে সকাল ১০টার দিকে আযাদ ও তার সহযোগীরা ফরিদপুর শহরের খাবাশপুরের রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে ধরে নির্যাতন করে সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়।

সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর আকরাম কোরাইশির সঙ্গে মুজাহিদও উপস্থিত ছিলেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে রণজিৎকে হত্যার জন্য ফরিদপুর জিলা স্কুলের সামনে এবং পরে বিহারি কলোনির পূর্বাংশে মোল্লাবাড়ি রোডে রশিদ মিয়ার বাড়িতে নিয়ে যান আযাদ।

সেখানে আটকে রেখে রণজিতের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। তবে গভীর রাতে রণজিৎ জানালা ভেঙে পালিয়ে যান।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, ২৬ জুলাই বেলা ১১টার দিকে আলফাডাঙ্গা থেকে ধরে আনা আবু ইউসুফকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আটকে রেখে আযাদ অমানবিক নির্যাতন করেন। ইউসুফ স্টেডিয়ামের বিভিন্ন ঘরে খলিলুর রহমান, মাসুদ, হামিদসহ ৪০০-৫০০ নারী ও পুরুষকে আটক অবস্থায় দেখেন।

এক মাস ১৩ দিন সেখানে আটক থাকাকালে কিশোরীদের অপহরণ করে এনে তাদের ওপর আযাদ ও তার সহযোগীদের নির্যাতন চালাতে দেখেন ইউসুফ।

অষ্টম অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৮ মে সকাল ১০টার দিকে আযাদ সাত-আটজন রাজাকার সদস্যকে নিয়ে সালথা থানার উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রাম থেকে হিন্দু এক তরুণীকে অপহরণ করে খাড়দিয়া গ্রামের চান কাজীর বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করেন। সাত-আট দিন পর মুক্তি পান ওই তরুণী।

হত্যা: তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ অভিযোগে আযাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ মে আযাদ ১০-১২ জন রাজাকার সদস্যসহ বোয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের সুধাংশু মোহন রায়কে গুলি করে হত্যা করেন। এ সময় সুধাংশুর বড় ছেলে মনিময় রায় গুলিতে গুরুতর আহত হন।

চতুর্থ অভিযোগ অনুযায়ী, ওই বছরের ১৬ মে বেলা ৩টার দিকে আযাদ ১০-১২ জন রাজাকার সদস্যকে নিয়ে সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামে যান এবং মাধব চন্দ্র বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করেন।

আর ৩ জুন আযাদের নেতৃত্বে ১০-১২ জন রাজাকার সদস্য সালথার ফুলবাড়িয়া গ্রামে হিন্দুপাড়ায় লুটপাট চালায়। সেখানে তারা চিত্তরঞ্জন দাসকে গুলি করে হত্যা করে বলে ষষ্ঠ অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

ধর্ষণ: পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ৮ জুন দুপুর ১২টার দিকে আযাদ রাজাকার সদস্যদের নিয়ে বোয়ালমারী থানার নতিবদিয়া গ্রামের এক হিন্দু বাড়িতে হামলা চালান। আযাদ ও তার সহযোগীরা ওই বাড়ির দুই নারীকে ধর্ষণ করেন।

গণহত্যা: সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, ১৭ মে রাজাকার বাহিনীর ৩০-৩৫ জন সদস্যকে নিয়ে আযাদ বোয়ালমারী থানার হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় লুটপাট চালন এবং ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন।

পরে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শরৎ চন্দ্র পোদ্দার, সুরেশ পোদ্দার, শ্যামাপদ পোদ্দার, যতীন্দ্র মোহন সাহা, নীল রতন সমাদ্দার, সুবল কয়াল ও মল্লিক চক্রবর্তীকে হত্যা করেন তারা। হরিপদ সাহা ও প্রবীর কুমার সাহা ওরফে পুইট্যাকে অপহরণের পর ময়েনদিয়া বাজারের নদীর ঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

আযাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরু হলে তার পক্ষে শুনানি করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আবদুস শুকুর খানকে নিয়োগ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ২২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেননি।