মসজিদ নির্মাণ নিয়ে উত্তেজনা, হিন্দু বাড়িতে আগুন

হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের চিরির বন্দর উপজেলায় হিন্দুদের অন্তত ২০টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে আরো কয়েকটি বাড়িতে। (আরো তথ্যসহ)

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 August 2012, 05:37 AM
Updated : 4 August 2012, 05:37 AM
ঢাকা, অগাস্ট ০৪ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের চিরির বন্দর উপজেলায় হিন্দুদের অন্তত ২০টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে আরো কয়েকটি বাড়িতে।
মসজিদ নির্মাণ নিয়ে উত্তেজনার কারণে প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারার মধ্যেই শনিবার সকাল ১০টায় অমরপুর ইউনিয়নের রাজাপুর এবং পাশের আব্দুলপুর ইউনিয়নের মাজপাড়া গ্রামে এই হামলা হয়।
উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হামলায় উস্কানির অভিযোগ করেছে স্থানীয় কয়েকজন।
এদিকে হামলা-ভাঙচুরে জড়িত থাকার অভিযোগে আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রশিদুল মন্নাফ কবীর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসক জামাল উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হঠাৎ করেই বিপুল সংখ্যক লোক সমবেত হয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত ছিলো বলেই জীবনহানির মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।”
উত্তেজনা চলছিল বলেই প্রশাসন শুক্রবার ১৪৪ ধারা জারি করেছিল জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, “হঠাৎ করে এতো লোক সমবেত হবে এটা ধারণা ছিলো না।”
উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, এ অভিযোগের তদন্তের জন্য এক সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা মেজিস্ট্রেট আব্দুল মালেককে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটিকে দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, ১২টি বাড়ির ৩৫টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। এই ঘটনায় মামলা করার প্রস্তুতি চলছে এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হবে।
এর আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবীর সাংবাদিকদের বলেন, অমরপুর ইউনিয়নের বলাইবাজারে জনৈকা হামিদা বানু তার নিজস্ব জায়গায় ৩/৪ দিন আগে একটি মসজিদ নির্মাণ শুরু করলে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় বাধা দেয়।
এ নিয়ে উভয় পক্ষকে সমঝোতার আহবান জানিয়ে পরিস্থিতি অবনতির আশংকায় শুক্রবার বিকাল থেকে সেখানে ১৪৪ ধারা জারি এবং পুলিশ মোতায়েন করে স্থানীয় প্রশাসন।
“কিন্তু আজ (শনিবার) সকাল ১০টার দিকে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার লোক লাঠি-সোঁটা নিয়ে রাজাপুর গ্রামে আকস্মিক হামলা চালিয়ে হিন্দুদের ঘর-বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে,” বলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
তিনি জানান, বেলা ১টার দিকে আব্দুলপুর ইউনিয়নের মাজাপাড়া গ্রামে হামলা চালিয়ে হিন্দুদের ৬/৭টি বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
খবর পেয়ে দুটি স্থানে পুলিশ লাঠিপেটা ও রবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান।
অমরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দুই গ্রামে প্রায় ২০/২২টি বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
“হামলাকারীরা সবাই ছিল অন্য এলাকার। পাশের পার্বতীপুর উপজেলার লোকও ছিল,” বলেন তিনি।
ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রফুল্ল রায়, ক্ষিতিশ রায়, সুভাষ চন্দ্র এবং যোগেশ্বরের বরাত দিয়ে দিনাজপুর থেকে প্রকাশিত দেশ বার্তার সম্পাদক চিত্ত ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই হামলা চালানো হয় তাদের ওপর।
হামলাকারীরা বাড়ি ঘর জালিয়ে দেওয়া ছাড়াও গরু, ছাগল, হাঁস মুরগি, ধান, চাল লুট করে। এমনকি তারা নলকূপ পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়।
ঘটনাস্থল ঘুরে আসা চিত্ত ঘোষ বলেন, “এলাকার লোকজন অভিযোগ করেছেন শুক্রবার মধ্যরাতে ১৪৪ ধারা জারির যে মাইকিং করা হয়েছিল সেখানে উস্কানি মূলক বক্তব্য ছিলো। এরপর থেকেই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়।”
মাইকিং করার সময় বলা হয়, ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মসজিদ নির্মাণে বাধা দিচ্ছে। এজন্য উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। তাই ১৪৪ ধারা জারি করা হচ্ছে।’
হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ চিরিরবন্দর শাখার সাধারণ সম্পাদক বিকাশ রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হামিদা বানুর জায়গার সঙ্গে রাস্তার জায়গা নিয়ে মসজিদ বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে স্থানীয় কয়েকজন বাধা দেয়। তারা রাস্তার জায়গা ছেড়ে মসজিদ বানানোর অনুরোধ করেন।”
কিন্তু বিষয়টি ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আশেপাশে মসজিদে মসজিদে শুক্রবার জুম্মার নামাজে উস্কানিমূলক বক্তব্য এবং লিফলেট ছড়ানো হয় বলে জানান বিকাশ রায়।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে এরকম আঁচ করতে পেরে পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসনের কাছে শুক্রবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত ধর্ণা দিয়ে রাত ১২টার দিকে ১৪৪ ধারা জারি করানো হয়।
মসজিদ নিয়ে স্থানীয় হিন্দুদের আপত্তির বিষয়ে সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোতালেব হোসেন ও বর্তমান চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী উভয়ই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বলাইবাজার-রাজাপুর এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো মুসলমানের বাস নেই। তাই এলাকার হিন্দুরা বলছিল, এখানে মসজিদ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
মসজিদ নির্মাণকারী হামিদা বানু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ২০০৬ সালে সেখানে তার নিজস্ব জমিতে নির্মিত মার্কেটের সঙ্গে মসজিদটি করা হয়। এখানে বাজারে আসা লোকজন নামাজ পড়েন। মুসল্লিদের অনুরোধে নামাজ ঘরটি নতুন করে পাকা করতে গেলে হিন্দুরা বাধা দেয়।
“আমার নিজের জায়গায় মসজিদ করতে পারব না- এ কোন ধরনের দাবি,” বলেন তিনি।
ওই এলাকায় মুসলমানদের বাস না থাকার বিষয়টি তুলে ধরলে হামিদা বলেন, “এলাকায় মুসলমান বসবাস করে না বলে মসজিদ করা যাবে না, এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না।”
সকালে সহিংসতার পর বিকালে জেলা প্রশাসক আজিজুল ইসলাম, পুলিশ সুপার ময়নুল ইসলামসহ জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। এলাকাজুড়ে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যরা টহল দিচ্ছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/প্রতিনিধি/এলএইচ/এমআই/১৭২৬ ঘ.