পশু চিকিৎসকহীন সুন্দরবন

বাঘসহ ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাস সুন্দরবনে বন বিভাগের কোনো পশু চিকিৎসক নেই। শুধু সুন্দরবনই নয়, লোকবল সঙ্কট পুরো বন বিভাগেই। মঈনুল হক চৌধুরীর প্রতিবেদন।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2010, 07:55 AM
Updated : 25 July 2010, 07:55 AM

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাস। বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ থাকলেও এখন পর্যন্ত সুন্দরবনে নেই একজন পশু চিকিৎসক।

শুধু চিকিৎসকই নয়, জনবল সঙ্কটে রয়েছে বন অধিদপ্তর; বর্তমানে শূন্য আছে ১ হাজার ২৮২টি পদ।

সুন্দরবনকে চারটি রেঞ্জ রয়েছে। সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগেই ৮টি করে মোট ১৬টি স্টেশন রয়েছে। আর ক্যাম্প রয়েছে ৮০ থেকে ৯০টি।

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রত্যেক ক্যাম্পে ৫ জনের জায়গায় কাজ করছে ৩ জন। আর প্রত্যেক স্টেশনে ১০ থেকে ১৫ জনের স্থানে কাজ করছে ৫ থেকে ৭ জন।

বছরের শুরুতে সাতক্ষীরায় এ বাঘ মারা যাওয়ার ঘটনায় বন কর্মকর্তাদের অদক্ষতাকেও দায়ী করেছে অনেকে।

ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে দক্ষ ও প্রয়োজনীয় লোকবল সঙ্কট রয়েছে বলে শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী বিষয়ক বন সংরক্ষক তপন কুমার দে।

গত বৃহস্পতিবার বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সংসদে জানান, বন অধিদপ্তরে বর্তমানে ১ হাজার ২৮২টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর ১০০টি, বাকিগুলো দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারি।

এসব পদে ৭৫৯টি সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে এবং ৫২৩টি পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণযোগ্য বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন বিভাগের অনিয়ম, বনদস্যুদের অপতৎপরতা ও জনবলের অপ্রতুলতায় সুন্দরবনের জাতীয় সম্পদ এখন হুমকির মুখে। বাঘ সংরক্ষণে সরকারের নেই পর্যাপ্ত স্পর্শকাতর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষ জনবল।

সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা না গেলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়ের আগেই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্তি ঘটতে পারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো আরো কিছু প্রজাতির।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি সংস্থা ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশের (ডব্লিউটিবি) নির্বাহী প্রধান মো. আনোয়ারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সুন্দরবনে বন্যপ্রাণীর যথাযথ চিকিৎসার জন্যে একজনও পশুচিকিৎসক না রাখার বিষয়টি ছিলো সরকারের দূরদর্শিতার অভাব।

বাঘের কোনো অসুখ হলে কিংবা জরুরি প্রয়োজনে কক্সবাজারের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক থেকে আনতে হয় পশু চিকিৎসক।

অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, "বন্যপ্রাণী সম্পর্কে মানুষেরও উঁচু মানের কোনো ধারণা নেই। এর উপর এ পর্যন্ত শুধু বাঘ নয়, যে কোনো বন্যপ্রাণী হত্যার জন্য একজনকেও জেল-জরিমানার মতো শাস্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত নেই।"

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

১৯৯৯ সালে সুন্দরবনের ৩২,৪০০ হেক্টর এলাকাকে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। এখানে ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪০০ প্রজাতির মাছ ও ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।

জনবলের অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করে প্রধান বন সংরক্ষক মো. আব্দুল মোতালেব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে এখানে পশু চিকিৎসক ছিলো না। প্রয়োজনে অন্য জায়গা থেকে আনা হতো। বর্তমানে পরিস্থিতিতে পরিবেশ সংরক্ষণে সবাই সচেষ্ট হয়েছে এবং সরকারও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে।

সরকার ২০০৯-২০১৭ সালের জন্য বাঘ কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। ২০১২ সাল পর্যন্ত সাড়ে ১৯ কোটি ব্যয়ে সুন্দরবন ব্যবস্থাপনা সহায়তা প্রকল্প, সাড়ে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সুন্দরবনের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও পুনর্বাসন এবং প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সুন্দরবনের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে।

এছাড়া ১০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ইউএসএআইডি-এর সহায়তায় সুন্দরবন এনভার্নমেন্টাল লাইভলিহুড সিকিউরিটি প্রকল্প প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বাঘ সম্পদ সংরক্ষণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান বন ও পরিবেশ সচিব মিহির কান্তি মজুমদার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "দক্ষ জনবল তৈরি করা হচ্ছে। ট্রাঙ্কুলাইজার বন্দুক ব্যবহার করে চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগে বন্যপ্রাণী আটক করার জন্য ইতিমধ্যে একটি দলকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

সুন্দরবনে পশু চিকিৎসকসহ আরো কিছু পদ সৃষ্টির জন্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়েছে বলে জানান সচিব।

ইদানীং লোকালয়ে আসার পর বাঘ মারার ঘটনায় হাজার হাজার গ্রামবাসী জড়িত থাকায় এর বিরুদ্ধে কিছু করা যায় না বলে মন্তব্য করেন প্রধান বন সংরক্ষণ আব্দুল মোতালেব।

এক সময় বাংলাদেশের সবগুলো বনে বাঘ ছিল। এখন শুধু সুন্দরবনেই তারা আছে। বাঘের আটটি উপ প্রজাতির মধ্যে জীবিত আছে মাত্র ৫টি।

২০০৪ সালে বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনডিপি পরিচালিত যৌথ শুমারিতে (পাগমার্ক পদ্ধতি) বলা হয়, সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ রয়েছে।

বিশ্বের ১৪টি দেশে বর্তমানে বাঘের অস্তিত্ব রয়েছে। ১৯০০ সালে সারা বিশ্বে প্রায় এক লাখ বাঘ ছিল। বর্তমানে তা কমে এসেছে ৩,২০০টি।

বৈশ্বিক হুমকি সত্ত্বেও আগামীতে বাঘ টিকিয়ে রাখতে হলে অবৈধ শিকার বন্ধের ব্যবস্থা এবং মানুষ-বাঘ সংঘাত বন্ধের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করেন বাঘ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আনোয়ার।