সুবীর ভৌমিক কি ‘র’ এর এজেন্ট, প্রশ্ন মাহমুদুরের

শেখ হাসিনাকে ‘হত্যাচেষ্টার’ ‘বানোয়াট’ সংবাদ বিদেশি সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক কাদের স্বার্থে দিয়েছেন, তা জানতে চেয়েছেন খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Sept 2017, 03:08 PM
Updated : 27 Sept 2017, 04:43 PM

মিয়ানমারের অনলাইন সংবাদ মাধ্যম ‘মিজিমা নিউজ’র সুবীর ভৌমিকের ওই সংবাদ প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনার মধ্যে মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক অনুষ্ঠানে মাহমুদুর বলেন, “তার একটি ভারতীয় কানেকশন রয়েছে, অনেকেই তাকে ‘র’ (ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) এর এজেন্ট বলে থাকে, তারই বক্তব্য।

“তিনি র- এর এজেন্ট, না কি অন্য কারও এজেন্ট, সেটা আমরা জানি না। তবে ভারত সরকারের সঙ্গে তার যে একটি সংযোগ রয়েছে, এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।”

সম্প্রতি মিজিমা নিউজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর হামলার একটি ব্যর্থ চেষ্টার খবর আসে, যা পরে ভারতের সংবাদ মাধ্যমেও প্রচার ও প্রকাশ হয়। তার সূত্র ধরে বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমেও বিষয়টি আসে।

এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এই ধরনের খবর ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়।

বক্তব্য রাখছেন মাহমুদুর রহমান

 

দৈনিক আমার দেশের প্রতিষ্ঠাকালীন উপদেষ্টা সম্পাদক আতাউস সামাদের স্মরণসভায় সংবাদপত্রটির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান প্রধানমন্ত্রীকে ‘হত্যাচেষ্টার’ ওই সংবাদটির প্রসঙ্গ টেনে সুবীর ভৌমিককে নিয়ে কথা বলেন।

তিনি বলেন, “এই সুবীর ভৌমিকের পরিচয়টি কী? তার এক নম্বর পরিচয় তিনি দীর্ঘদিন বিবিসিতে ছিলেন। দ্বিতীয় পরিচয় হচ্ছে, তার একটি ভারতীয় কানেকশন রয়েছে…

“তৃতীয় আরেকটি পরিচয় আছে, বাংলাদেশে একটি সংবাদ সংস্থা আছে, প্রাইভেট, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তিনি নাকি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক। আমি বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ছিলাম। বিনিয়োগ বোর্ডের একটা দায়িত্ব হচ্ছে, বিদেশি কেউ যদি বাংলাদেশে চাকরি করতে আসে তাহলে তার অনুমতি বিনিয়োগ বোর্ড থেকে নিতে হয়। আমি জানি না সুবীর ভৌমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে যে চাকরি করছেন, তার কোনো অনুমতি তিনি সরকারের কোনো সংস্থার কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন কি না?”

এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একজন মুখপাত্র বলেন, সুবীর ভৌমিক ২০১৬ সালের মে মাস পর্যন্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন। বিশ্বের বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সংবাদদাতা বা সম্পাদকরা যেমন নয়া দিল্লিভিত্তিক বা এশিয়া সংবাদদাতারা সিঙ্গাপুরভিত্তিক হয়ে থাকেন, তেমনিভাবে তিনি কলকাতাভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন।

“সাংবাদিকতায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সুবীর ভৌমিককে জ্যেষ্ঠ সম্পাদক পদবী দেওয়া হয়েছিল। তিনি কখনোই বাংলাদেশে বা ঢাকায় বসে কাজ করেননি। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমতির দরকার পড়েনি।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম মুখপাত্র বলেন, চুক্তিকাল পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়েই তাকে বৈধ পথে তার সম্মানী ও ভাতা প্রদান করা হয়েছে। অন্যান্য বৈদেশিক সংবাদদাতাদেরও একইভাবে বৈধ উপায়ে সম্মানী প্রদান করা হয়ে থাকে।

ওই মুখপাত্র বলেন, ২০১৬ সালের মে মাসে চুক্তির মেয়াদ শেষে সুবীর ভৌমিক ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পরামর্শকপ্যানেলের একজন সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তখন থেকে তিনি অনিয়মিত কলাম ও বিশ্লেষণ লিখেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য। নিয়মিত সংবাদদাতার কাজ করেননি। ফলে এ বিষয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। 

মাহমুদুর বলেন, “সুবীর ভৌমিক কী করেছেন, তিনি বার্মিজ এক ভদ্রলোক তার নাম সু’য়ে মিন্ট, এই লোকটি বার্মার একটি বিমান হাইজ্যাক করে ভারতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ভারত সরকার তাকে খাইয়ে-পড়িয়ে কলকাতায় রেখেছে। সেই সু’য়ে মিন্ট এখন ‘মিজিমা’ নামে একটি সংবাদ সংস্থা বা কিছু একটার এডিটর। এখন এই সুবীর ভৌমিক এবং সু’য়ে মিন্ট এই ‍দুজন মিলে একটা কাহিনীর জন্ম দিয়েছে।”

সুবীর ভৌমিক

এই সংবাদটি নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে আলোচনায় সুবীর ভৌমিককে ডাকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কর্পোরেট নির্বাহী থেকে পত্রিকা কিনে সম্পাদক বনে যাওয়া মাহমুদুর রহমান।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা থেকে বিএনপি আমলে রাজনৈতিক নিয়োগে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান হয়েছিলেন মাহমুদুর। তখন বাংলাদেশে ভারতীয় শিল্প গ্রুপ টাটার বিনিয়োগ আনতে তৎপর ছিলেন তিনি। ওই আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন তিনি। তবে তার সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় বিভিন্ন মহলের বিরোধিতায়।

পরে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন মাহমুদুর। বিএনপি ক্ষমতা হারানোর পর মোসাদ্দেক আলী ফালুর মালিকানাধীন দৈনিক আমার দেশের বেশিরভাগ শেয়ার কিনে তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন তিনি।

মাহমুদুর বলেন, “বাংলাদেশে নাকি একটি আইসিটি আইন রয়েছে, সেই আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার সর্বপ্রথম ভিকটিম আমি। আজ পর্যন্ত আমার দেশ প্রেস যে বেআইনিভাবে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, সেটাও এই ৫৭ ধারা বলে।

“আমার প্রশ্ন হল, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, যেখানে সুবীর ভৌমিক চাকরি করেন, কিংবা যে সকল টেলিভিশন চ্যানেল অথবা যে সকল পত্রপত্রিকায় এই বানোয়াট সংবাদটি প্রচার হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে আইসিটির ৫৭ ধারা আজ প্রযোজ্য হচ্ছে না কেন?

“তার মানে কি এটাই, ভারতীয় কারও বিরুদ্ধে কিংবা ভারতের দালাল কারও বিরুদ্ধে কিংবা শেখ হাসিনার তল্পীবাহক কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বা সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে এই আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ব্যবহৃত হবে না?”

মিজিমা নিউজসহ ভারতের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ হাসিনার উপর ‘ব্যর্থ হামলার’ ওই খবরটি বাংলাদেশে সরকারি সংস্থা বাসসসহ বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রকাশ ও প্রচার হলেও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে তা প্রকাশিত হয়নি।

আতাউস সামাদের সঙ্গে সদ্যপ্রয়াত সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরী স্মরণে আয়োজিত এই সভায় মাহমুদুর ছাড়াও বক্তব্য দেন বিএনপি সমর্থক পেশাজীবী নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (একাংশ) সভাপতি শওকত মাহমুদ, মহাসচিব এম আব্দুল্লাহ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মোরসালিন নোমানী, কবি হাসান হাফিজ প্রমুখ।

সুবীর ভৌমিকের প্রতিক্রিয়া

মাহমুদুর রহমান ‘র’ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ তুলেছেন, তা উড়িয়ে দিয়ে সুবীর ভৌমিক তার লেখা বই পড়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে পাঠানো এক প্রতিক্রিয়ায় এই সাংবাদিক বলেছেন, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে এক সময় পাহাড়িদের সশস্ত্র বিদ্রোহে ‘র’ এর ‘মদদের’ যে তথ্য তিনি তুলে এনেছিলেন, তা বাংলাদেশি কেউই করেনি।

“যারা আমাকে ‘র’ এর এজেন্ট বলে, তাদের আমি আমার অক্সফোর্ডের অভিসন্দর্ভ (থিসিস) এবং আমার প্রকাশিত প্রথম বই ‘ইনসারজেন্ট ক্রসফায়ার’ পড়ে দেখতে বলব। সেখানে আমি তুলে এনেছি, কীভাবে র পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র আন্দোলনে (১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত) পেছন থেকে মদদ জুগিয়েছিল। এই কাজ বাংলাদেশের কেউই এখন পর্যন্ত করেনি।”  

সুবীর ভৌমিক বলেছেন, পেশাগত কারণে ‘র’ এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে এবং এমন যোগাযোগ পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, বাংলাদেশের এনএসআই, ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও রয়েছে।

“তথ্য থাকলে ‘র’-এর বিরুদ্ধে লিখতেও আমার কখনও কোনো দ্বিধা নেই।”

এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পেশাগত কারণে পরেশ বড়ুয়াসহ উলফা নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কারণে ‘র’ এর কয়েকজন কর্মকর্তা তাকে ‘উলফার এজেন্ট’ হিসেবেও পরিচিত করার চেষ্টা চালিয়েছিল।

‘ভারতীয় কানেকশনের’ বিষয়ে সুবীর ভৌমিক বলেন, “আমি তো জন্মগতভাবে ভারতীয়, আমার পাসপোর্ট তো ভারতীয় পাসপোর্ট। তবে সম্ভবত আমি তার (মাহমুদুর) চেয়ে অনেক বেশি বাঙালি।”

বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতার চেতনা’ থেকে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি নিজের সমর্থন ঘোষণা করে সুবীর ভৌমিক বলেন,  সোয়ে মিন্টও মিয়ানমারের গণতন্ত্রের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক।

এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেখানে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নামই নিতে চায় না, তাদের ‘বাঙালি’ বলে, সেখানে মিজিমা নিউজ কিন্তু রোহিঙ্গা শব্দটিই লেখে।