বৌদ্ধদের নিয়ে ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে ‘ধর্মীয় উস্কানি’

মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতার প্রেক্ষাপটে বৌদ্ধদের নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদনে ‘ধর্মীয় উস্কানি’ দেখছেন একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু; তাতে সমর্থন মিলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যানের কথায়ও।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Sept 2017, 05:53 PM
Updated : 19 Sept 2017, 06:18 PM

তবে ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষ বলছে, কাউকে আঘাত দেওয়া কিংবা উস্কানির জন্য নয়, কিছু মৌলবাদী শান্তির ধর্ম নষ্ট করছে, সেটা ‘দেখানোর জন্য’ এই প্রতিবেদন।

মঙ্গলবার ‘অহিংস বুদ্ধের অনুসারীদের সহিংস কর্মকাণ্ড’ শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রতিবেদন ছাপে পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মালিকানাধীন দৈনিক ইত্তেফাক, যেটি তৈরি করেন আনোয়ার আলদীন।

সেখানে ধর্মীয় ব্যাপারে বিভিন্ন মতামতকে মনগড়া হিসাবে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়।

‘মতামতধর্মী লেখায়’ রাখাইনের সহিংসতাকে মুসলিম ও বৌদ্ধদের মধ্যে সংঘাত হিসাবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মফিজুর রহমান।

প্রতিবেদনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এভাবে ‍বুদ্ধের নাম নিয়ে অনেক রিপোর্ট করা হচ্ছে। এগুলোর কারণে আমরা বিপন্নবোধ করছি। আমরা যারা মাইনরিটিগুলো এখানে আছি তারা।

“মিয়ানমারে কী হচ্ছে, এটার সঙ্গে আমরা কোনোভাবে ইনভলভড না। এগুলো আমাদের বিষয় না, আমরা সমাধানও দিতে পারব না।”

তিনি বলেন, “এগুলো তো উস্কানিমূলক, কিছু সাংবাদিক আছে, উস্কানি দিচ্ছে। এ ধরনের লেখায় রোহিঙ্গারা রক্ষা পাবে না, আর এর বিপরীতে আমরা বিপন্ন হচ্ছি।”

“ওখানে কি কেউ বুদ্ধের নাম নিয়ে দাঙ্গা করতে গিয়েছে? ওখানে কি বুদ্ধের নাম নিয়ে আর্মিরা যুদ্ধ করতেছে?” প্রশ্ন করেন তিনি।

প্রতিবেদনের শেষাংশে লেখা হয়েছে, “বাংলাদেশের উপজাতিগুলোর বৃহত্তর অংশ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। বৌদ্ধ ধর্মে স্রষ্টার কোনো ধারণা নেই। বলা হয়ে থাকে বুদ্ধও নাকি স্রষ্টার প্রশ্নে নীরব ছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের ধর্মগ্রন্থকে স্রষ্টার বাণী হিসেবে বিশ্বাস করা হয় না। বৌদ্ধরা জন্মান্তরবাদ তথা কর্মের ওপর ভিত্তি করে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে বিশ্বাস করে।”

এই অংশটাকে ‘মনগড়া’ উল্লেখ করে ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় বলেন, “সৃষ্টিকর্তা নিয়ে বুদ্ধ বাড়াবাড়ি করতে না করেছেন। বলেছেন, তুমি প্রজ্ঞা উৎপন্ন কর, জ্ঞান উৎপন্ন কর, তোমাকে কে সৃষ্টি করছে, কীভাবে তুমি পৃথিবীতে এসেছ। তার আগে আমি যদি বলি, স্রষ্টা আছে, তাহলে আরেক গ্রুপ বলবে নাই। থাকলে এটার আকার প্রকার কী.. নাই বললে প্রশ্ন আসবে নাই কেন?

“তাই বুদ্ধ বলেছেন, তুমি জ্ঞান উৎপন্ন করো, প্রজ্ঞা উৎপন্ন করো, তখন তুমি বুঝতে পারবে- পৃথিবীটা কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে, কে সৃষ্টি করেছে, কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে?”

ইত্তেফাকের প্রতিবেদকের বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় বলেন, “এই ধরনের লেখা পাহাড়িদের বিপন্ন করবে। ওই যে এখন পাহাড়িদের অবস্থা, তাদেরকে রাস্তাঘাটে পিটাইতেছে, আরও মারবে- উস্কানি দেওয়া হলে।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, “বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থে কোনো বৌদ্ধ ‘মহাপাপ’ করে ফেললে তার কোনো রকম বিচার বা শাস্তির ব্যবস্থার কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। তবে তাদের ধর্মবেত্তারা বলে থাকেন, বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী একজন মানুষ খুন, হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন, যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাস ও অন্যান্য বড় বড় অপরাধ করার পর সেই ব্যক্তি নিজের অন্তরে অশান্তি বা শাস্তি অনুভব করে- এটাই তার অপরাধের শাস্তি। ধর্মগ্রন্থে পাপের শাস্তির কথা না থাকার ফলে সহিংস জাতি হয়ে ওঠার সুযোগ আছে তাদের।”

এই অংশে ধর্মের অপব্যাখ্যা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়।

মিয়ানমারে সহিংসতার বিষয়ে তিনি বলেন, “মিয়ানমারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে কিছু জাতীয়তাবাদী আছে, যারা সরকারের পক্ষে বিভিন্নভাবে মুভমেন্ট করতেছে। দেশে যেমন উগ্রবাদী আছে না কিছু, তাদের মতো। সুতরাং বাংলাদেশে আমরা জনমত গঠন করার জন্য সরকারকে সহায়তা করতে পারি। এর বেশি কিছু আমরা করতে পারব না। আমাদের যতটুকু করণীয়, মানববন্ধন, স্মারকলিপি দিয়েছি, সরকারকেও সহায়তা করছি।”

রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশের বৌদ্ধরা মিয়ানমার দূতাবাসে স্মারকলিপি দেওয়াসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। প্রবারণা পূর্ণিমায় ফানুস না ওড়ানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছে তারা।

রোহিঙ্গাদের পক্ষে ঢাকায় বৌদ্ধদের কর্মসূচি

ইত্তেফাকের প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক মফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা তো আসলে রিপোর্ট হয়নি, এটা একটা মতামত। মতামত নিয়ে আমি কথা বলতে পারি না।

“সাংবাদিকতার মানদণ্ডে এটাকে ফেলা যাবে না, এটা মতামতধর্মী উপস্থাপন। এখানে লেখক, বৌদ্ধ ধর্ম ও ইসলাম ধর্মের যে দুটি পক্ষ দাঁড় করিয়েছেন, ধর্মীয় রূপ দেওয়া হয়েছে এখানে।”

এ ধরনের প্রতিবেদন উস্কানি তৈরি করতে পারে কি না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “এভাবে দুইটা পক্ষ দাঁড় করালে তো কনফ্লিক্টিং অবস্থা তৈরি হতে পারে।”

সম্পাদকীয় নীতির প্রশ্নে এই প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিবেদনটি আমার নজরে আসেনি। এ বিষয়ে মন্তব্য করব না।”

প্রতিবেদন প্রকাশের ব্যাখ্যায় ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কীভাবে সহিংসতায় জড়িয়েছে, সেটা তুলে ধরতে এ প্রতিবেদন করা হয়েছে। তবে, এটাতে যদি কোনো উস্কানির বিষয় আসে, তাহলে আমরা সম্পাদকীয়তে সেটা দেখব।”

ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়, “রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে। নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। তাদের মুণ্ডহীন দেহ আর কর্তিত মস্তক রাস্তার পাশে প্রদর্শন করা হচ্ছে। নারী-পুরুষ ও শিশুদের আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।”

কিন্তু রাখাইনে এমন ঘটনার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর আগে প্রকাশ পেলেও সবগুলো যে সত্য নয়, তা বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের উপর সহিংসতার এই সময়ে শ্রীলঙ্কা, চীন, ক্যাম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ঘটনার উল্লেখ করা হলেও ওই সব দেশের ঘটনাবলি কেবল ধর্মীয় কারণেই সংঘটিত হয়েছে এমন তথ্য প্রতিবেদনে নেই। প্রতিবেদনে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রেরও উল্লেখ করা হয়নি।

আবার প্রতিবেদনে উল্লিখিত ‘বাংলার ধন-সম্পদ লুণ্ঠনকারী ঐসব বৌদ্ধ মগ নৌদস্যুদের বংশধররাই হচ্ছে আজকের মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়’ অংশটির ঐতিহাসিক তথ্যনির্ভরতার পক্ষে কোনো তথ্যও দেখানো হয়নি।

পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আশীষ সৈকত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৌদ্ধ ধর্মটা যে শান্তির জন্য এটা বিশ্ববাসী জানে, কিছু মৌলবাদীর জন্য এই শান্তির ধর্ম যেন নষ্ট না হয়। সেটাকে সামনে আনার জন্য, মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এটা (প্রতিবেদন) করা হয়।”

রোহিঙ্গা সহিংসতার আগে গত ২৪ এপ্রিল আরেকটি দৈনিক জনকণ্ঠের প্রথম পাতায় ‘পার্বত্য এলাকায় নতুন অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টায় ভাবনা কেন্দ্র’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের এক জায়গায় গৌতম বুদ্ধকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসাবে অভিহিত করায় প্রতিবাদ হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

পরবর্তীতে পত্রিকাটি দুঃখপ্রকাশ করে অংশটি প্রত্যাহার করে নেয় জনকণ্ঠ।

প্রাসঙ্গিক আরও খবর