রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ না করা এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সু চির কথা বলার সমালোচনা করেই তারা বলছেন, ক’দিন আগে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের কড়া বক্তব্যের পর সু চির ভাষণের সুর অনেকটাই নরম।
দীর্ঘকাল সামরিক শাসনের পর গণতন্ত্রের পথে পা ফেলা মিয়ানমারে সু চির সীমাবদ্ধতার কথাও বলেছেন প্রতিবেশী দেশটিতে বাংলাদেশের সাবেক এক রাষ্ট্রদূত; কেননা মিয়ানমারে সু চির দল ক্ষমতায় থাকলেও এখনও সেনাবাহিনীকে সমঝে চলতে হয় তাকে।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনার মুখে জাতিসংঘের চলতি সাধারণ অধিবেশনে না গিয়ে মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর সু চি।
তিনি বাংলাদেশে থাকা শরণার্থীদের যাচাই সাপেক্ষে ফেরত নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মুসলিমরা কেন রাখাইন ছাড়ছে, তা খুঁজে বের করার কথা বলেছেন; আশ্বাস দিয়েছেন কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের।
তবে বক্তব্যে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি তিনি, পাশাপাশি সেনাবাহিনীর নির্যাতনমূলক ভূমিকা নিয়েও নীরব থেকেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী এই নেত্রী।
ওই চুক্তির আওতায় মিয়ানমার সে সময় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। চুক্তি নির্ধারিত যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও ২৪১৫ জন শরণার্থীকে সে সময় মিয়ানমার থেকে আসা বলে নিশ্চিত হওয়া গেলেও মিয়ানমার তাদের আর ফিরিয়ে নেয়নি।
সু চির ভাষণকে ‘মিথ্যাচারে পূর্ণ’ বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রোহিঙ্গাদের এক নেতা। তিনি সেনাবাহিনীর অপরাধকে আড়াল করেছেন বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সমালোচনামুখর।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী বাংলাদেশের রাজনীতিক ও কূটনীতিকরা বলছেন, কৌশলগত কারণে অনেক কিছু এড়িয়ে গেলেও সু চি যে ইতিবাচক কথাগুলো বলেছেন, তা বাস্তবায়ন হলে সঙ্কট মোচনের একটা পথ তৈরি হতে পারে।
সু চির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত (২০০৯-২০১৪) অনুপ কুমার চাকমা তার অভিজ্ঞতার আলোকে সু চির সীমাবদ্ধতার কথা বলেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি (সু চি) ইচ্ছে করলেই অনেক কিছু করতে পারবেন না।
“যে আশাটা আমরা করেছিলাম; অনেকে যেরকম আশা করেছিল, হয়ত সে রকম হয়নি। কিন্তু আমি নেতিবাচক বিষয়গুলোর চেয়ে ইতিবাচক বিষয়গুলো বের করার চেষ্টা করেছি। কিছু কিছু বিষয় সু চি ভালো বলেছেন।”
সাবেক এই রাষ্ট্রদূতের মতে, ইতিবাচক পয়েন্টগুলো সঙ্কট সমাধানের জন্য হয়ত সাহায্য করবে।
এর মধ্যে রয়েছে-
>> মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা; লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস
>> যারা দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে তাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ
>> আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি
>> মুসলিমরা দেশ ছেড়ে পালানোয় উদ্বেগ;এর কারণ বের করার তাগিদ
>> আনান কমিশনের সুপারিশ যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়নের আশ্বাস
>> মিয়ানমারে যারা ফিরতে চায়, তাদের ভেরিফিকেশন প্রসেস দ্রুত শুরু করার আশ্বাস
>> ৫ সেপ্টেম্বরের পর কোনো সেনা অভিযান চলেনি (পরোক্ষভাবে স্বীকার করা হল ২৫ অগাস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চলেছিল)
অনুপ কুমার বলেন, “এটা বেশ ভালো দিক, এটা সমাধানের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সু চির এসব প্রতিশ্রুতি সমস্যা সমাধানের একটা পথ বের করতে পারে।
“তিনি যদি এ বিষয়গুলো শুধু কথার মধ্যে না রেখে আসলেই কাজে পরিণত করেন বা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করেন, তাহলে সমাধানের শুরুটা দ্রুত হবে।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে, আমরাও তাই চাই। উনি এটা বলে থাকলে খুবই পজিটিভ সাইন।
“কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করলেই হয়ে গেল। মিয়ানমান ও রোহিঙ্গাদের শান্তি আসবে এ প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন।”
সু চি গঠিত আনান কমিশন মুসলিম রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি দেশছাড়া শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার সুপারিশও করেছে।
জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান জি এম কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘদিন সামরিক একনায়কতন্ত্র চলেছে ... এখন যদিও গণতন্ত্র এসেছে, কিন্তু তা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। সম্ভবত দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে তিনি (সু চি) এতদিন নীরব ছিলেন।
“আমি খুবই পজিটিভলি দেখছি। ওখানকার (মিয়ানমার) সমস্যা আসলে খুবই জটিল। আমরা চাই, এই সমস্যার একটি আইনানুগ, বাস্তবসম্মত সলিউশন হোক।”
তবে সু চি রোহিঙ্গাদের বঞ্চিত করতেই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোহিঙ্গারা জন্মগতভাবে ওই দেশের নাগরিকের সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে। এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত করার জন্যে কৌশলে বাস্তবতা এড়িয়ে গেছেন সু চি।
এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
মিয়ানমারের নেত্রীর বক্তব্যে তার মতোই হতাশ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হায়দার আকবর খান রনো।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সু চি তার ভাষণে একবারও রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি, তারা যে মিয়ানমারের নাগরিক তা স্বীকার করেননি। সেনা অভিযান বন্ধের বিষয়েও তার বক্তব্য স্পষ্ট নয়।
“সুতরাং এখানে আমি আশাবাদী হওয়ার কারণ দেখছি না। আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে।”
সুচির বক্তব্যকে দায়সারা মনে করছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানও।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের যে চেষ্টা চলছে এতে দেশটির মিলিটারী জড়িত থাকলেও তার বক্তব্যে দায়ীদের সুরক্ষার কথাই বোঝা গেছে।”
সু চির বক্তব্যে ‘নতুন কিছু’ দেখছেন না ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তার কথায় এক ধরনের অপারগতার প্রকাশ হয়েছে। উনি সেনা ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে চাননি। যদিও সেনারাই হচ্ছে সেখানকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল ক্রীড়ানক।”
তবে আগে সব কিছু অস্বীকারের যে প্রবণতা ছিল, সু চির ভাষণে তা থেকে সরে আসা হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তা। এর মধ্য দিয়ে সু চি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সন্তুষ্ট করতে চাইছেন বলে মনে করেন রশীদ।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপেই সু চির এই বক্তব্য এসেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেনাপ্রধানের অবস্থানটার প্রায় বিপরীতে তার (সু চি) বক্তব্য। এক ধরনের কূটনীতিক কথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে টার্গেট করে।
সু চি যে কথাগুলো বলেছেন, তার বাস্তবায়নটা দেখতে চাইছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এ অধ্যাপক।
তাহলে ‘ইতিবাচক রাস্তা তৈরি হবে’ বলে মম্তব্য করেন তিনি।
[প্রতিবেদনটি সমন্বিতভাবে তৈরি করেছেন মঈনুল হক চৌধুরী, ফয়সাল আতিক, সালাউদ্দিন ওয়াহিদ প্রীতম, তাবারুল হক ও কাজী মোবারক হোসেন]