দ্বিজেন শর্মা আর নেই 

প্রাণ ও প্রকৃতির মায়া কাটিয়ে চিরবিদায় নিলেন ‘নিসর্গসখা’ লেখক দ্বিজেন শর্মা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2017, 03:41 AM
Updated : 15 Sept 2017, 11:38 AM

রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার ভোর পৌনে ৪টার দিকে তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল  ৮৮ বছর।

দ্বিজেন শর্মার পরিবারের বরাত দিয়ে লেখক মোকাররম হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিডনি ফেইলিওর, ফুসফুসে পানি জমে যাওয়া ছাড়াও মাল্টিপল অর্গ্যান ফেইলিওরের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।”

গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্বিজেন শর্মাকে গত বৃহস্পতিবার বারডেম হাসপাতাল থেকে স্কয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেদিন সন্ধ্যায় শুরু হয় ডায়ালাইসিস।

এর আগে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে গত অগাস্টেও দ্বিজেন শর্মাকে বারডেমে ভর্তি হতে হয়েছিল। ফুসফুসের সংক্রমণের ধাক্কা সামলে উঠতে পারলেও কিডনির জটিলতা আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।

মোকাররম হোসেন জানান, দ্বিজেন শর্মার মেয়ে শ্রেয়সী শর্মা লন্ডনে আছেন। তিনি দেশে ফিরলেই শেষকৃত্য হবে।

দ্বিজেন শর্মার স্ত্রী দেবী শর্মা জানান, তার স্বামীর মরদেহ শুক্রবার স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে। শেষকৃত্য কোথায় হবে তা ঠিক করা হবে তাদের মেয়ে শ্রেয়সী শর্মা লন্ডন থেকে ফেরার পর। তার আগে বাংলা একাডেমি ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দ্বিজেন শর্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।  

১৯২৯ সালের ২৯ মে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় দ্বিজেন শর্মার জন্ম। বাবা কবিরাজ ছিলেন বলে ছোটবেলা থেকেই লতা-পাতা, বৃক্ষ আর অরণ্য-প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে।

জীবিকার তাড়না জীবনকে যেখানেই নিয়ে যাক, দ্বিজেন শর্মা নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন প্রাণ ও প্রকৃতির রূপের সন্ধানে। উদ্ভিদ জগৎ, প্রকৃতি বিজ্ঞান আর বিজ্ঞান ভাবনা নিয়ে লিখে গেছেন প্রায় দেড় ডজন বই।    

দ্বিজেন শর্মা রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন, তৈরি করেছেন উদ্যান ও বাগান। গাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ এবং প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ার জন্য আজীবন প্রচার চালিয়ে গেছেন।

এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “আমি একদিন থাকব না, কিন্তু গাছগুলো থাকবে। মানুষকে অক্সিজেন বিলাবে। জীবনে এর চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে নেই।”

উদ্ভিদ ও প্রকৃতি নিয়ে তার লেখা ‘শ্যামলী নিসর্গ’কে বিবেচনা করা হয় আকরগ্রন্থ হিসেবে। তার বইয়ে গাছ, ফুল বা ফলের বর্ণনায় ফিরে ফিরে এসেছে ময়মনসিংহ গীতিকা, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, সিলেটের লোকগীতি কিংবা মধ্যযুগের কাব্যগাথা।

কলকাতা সিটি কলেজ থেকে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে দ্বিজেন শর্মা উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে করিমগঞ্জ কলেজ, বি এম কলেজ ও নটর ডেম কলেজে চাকরি করেন।

পরে প্রগতি প্রকাশনে চাকরি নিয়ে মস্কো চলে যান, সেখানে কাটে প্রায় কুড়ি বছর। দেশে ফিরে কাজ করেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে।

তার অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ‘সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস’, ‘ফুলগুলি যেন কথা’, ‘গাছের কথা ফুলের কথা’, ‘এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি’, ‘নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’, ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’, ‘জীবনের শেষ নেই’, ‘বিজ্ঞান ও শিক্ষা: দায়বদ্ধতার নিরিখ’, ‘ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’, ‘বিগল যাত্রীর ভ্রমণ কথা’, ‘গহন কোন বনের ধারে’, ‘হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার’, ‘বাংলার বৃক্ষ’।

বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষ সংযোগের কারণে কিছুকাল আত্মগোপন, এমনকি কারাবাসও করতে হয়েছে দ্বিজেন শর্মাকে। লেখালেখির জন্য ভূষিত হয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন জাতীয় সম্মাননায়।

তার স্ত্রী দেবী শর্মা ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজের সাবেক শিক্ষক। সুমিত্র শর্মা ও শ্রেয়সী শর্মা তাদের দুই ছেলেমেয়ে।

দেবী শর্মা তাদের সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় সাংবাদিকদের বলেন, “৫৫ বছর সংসার করেছি আমরা। জড়িয়ে ছিলাম তার সব ভাবনা চিন্তাতেও। কেবল আপনজন হিসেবে নয়, এক ভিন্ন মানুষ হিসেবে দেখলেও বলব, তিনি এক পবিত্র সাত্ত্বিক জীবন যাপন করে গেছেন।”

তিনি বলেন, দ্বিজেন শর্মা ঢাকার বিভিন্ন সড়ক কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, রাধাচূড়াসহ নানা ফুলের বৃক্ষে সাজাতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, ঢাকা হবে ‘গার্ডেন সিটি’।

দ্বিজেন শর্মার মৃত্যুর খবরে তার বাসায় ছুটে যান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাহিত্যিক হায়াৎ মামুদ, প্রাবন্ধিক-গবেষক মফিদুল হক, সিপিডির দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজিব কুমার সাহা, অধ্যাপক সুশান্ত কুমার সরকার, লেখক মোকাররম হোসেন ও মুকিত মজুমদার বাবু।

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “শুধুমাত্র প্রকৃতি নিয়ে লেখালেখি নয়, দ্বিজেন শর্মা তরুণদের পরিবেশপ্রেমী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে গেছেন সংগঠক হিসেবে। তার অনুসারীর সংখ্যা এখন বিশাল। আমার মনে হয়, তার অসমাপ্ত কাজগুলো এখন তারাই এগিয়ে নিয়ে যাবে।”

প্রকৃতি  বা বাংলার লোকজ ঐতিহ্য নিয়ে তার লেখা বিভিন্ন রচনা বাংলা সাহিত্যের ‘অমূল্য সম্পদ’ হয়ে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী।