প্রাণ নিয়ে বেঁচে আসা অনেক নারী পুরুষ কেউ নির্বাক হয়ে, কেউ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে নিজের বাড়ি পোড়ানোর দৃশ্য দেখছিলেন সোমবার।
এর মধ্যে শাহপরীর দ্বীপের ঠিক উল্টোপাশে গর্জনদিয়া নামের একটি পাড়ার বাসিন্দা আবদুল হামিদও দেখছিলেন নিজের এবং স্বজন-প্রতিবেশীদের ঘর পোড়ার এই দৃশ্য।
হামিদের দৃষ্টি বাড়ি পোড়ানোর এই দৃশ্যে নিবিষ্ট হয়ে থাকলেও মন পড়ে ছিল একই জেলার অন্য এক থানা ভুসিডং-এর ইনসং মহল্লার। নিজ বাড়ি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের এই মহল্লায় তার নানা বাড়ি। যেখানে বাস করতেন অনেক স্বজন।
এক মামাত ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে পেরেছেন হামিদ।
তিনি জানালে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাড়িতে হানা দেওয়ার পর থেকেই তার স্বজনদের অনেকে চলে গেছেন পাশের বনে। এরপর সেখানেই আটকা পড়ে আছেন তারা। কে মারা গেছে, কে বেঁচে আছে-সেই হিসেব এখনও করা হয়নি।
বনে পালিয়ে গিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে জানান হামিদের সেই ভাই। তিনি হামিদকে জানিয়েছেন, খিদের জ্বালা মেটাতে তাদেরকে খেতে হচ্ছে এখন গাছের পাতা।
তার ভাষ্য, চার দিকেই রয়েছে সেনাবাহিনীর প্রহরা। এ কারণে কেউ সেখান থেকে বের হতেও পারছেন না।
হামিদের আশঙ্কা, তার নানা বাড়ির সব স্বজনই মারা পড়বেন এভাবে।
শাহপরীর দ্বীপের রয়েছে দুটি অংশ। মিয়ানমারের কাছাকাছি অংশটিতে যেতে নৌকা বা স্পিড বোটে উঠতে হয়। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা এখানেই নামেন।
দুপুরে শাহপরীর দ্বীপের সেই নৌকা ঘাটে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে দেখা গেল এক নারীকে, মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠছিলেন তিনি। কয়েকটি শিশু তাকে ঘিরে ছুটোছুটি করছে।
এই দৃশ্য দেখে এগিয়ে যেতেই হাসিনা আক্তার নামে ওই নারী জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চলমান অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে তার স্বামী। সন্তানদের নিয়ে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে।
হাসিনার স্বপ্ন ছিল একদিন ফিরবেন স্বামীর ভিটায়। কিন্তু এখন তিনি দেখছেন পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, রোববারই তাদের মহল্লায় সেনা সদস্যরা এসেছিল। তখন তিনি অন্য পাড়ায় চলে গিয়েছিলেন।
পুরো মহল্লায় আগুনে জ্বলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখের অশ্রু কোনোভাবেই বাধ মানছিল না হাসিনার।
শাহ পরীর দ্বীপের জেটি ঘাটে বসে ঘর পোড়ানোর দৃশ্য দেখছিলেন নুর বেগমও।
পাড়ায় কী হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পুরুষদের জবাই করে দেয়। ছেলেদেরকে পেলে কুডি ফালাই দেয়।”
আরেক নারী সেতারা বেগমের স্বামীও মারা গেছেন সেনা অভিযানে।
স্বামীকে কবরস্থানে নিয়ে কবর দিয়েও আসতে পারেননি তিনি। সেনা সদস্যরা চলে যাওয়ার পর মহল্লার পাশে কোনো রকমে কবর দিয়েছেন। এরপর পরে আরেকটি সুযোগে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন।
এখন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন স্বামীর ঘর পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য।