রোহিঙ্গা সঙ্কট: মিয়ানমারকে চাপ দিতে সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিকত্ব দিয়ে নিরাপদে বসবাস করার সুযোগ করে দিতে মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ দেওয়ার একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Sept 2017, 04:06 PM
Updated : 12 Sept 2017, 03:53 AM

মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে এই দফায় ৩ লাখের মতো রোহিঙ্গার পালিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের মধ্যে জাতীয় সংসদের সোমবারের অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়।

সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ ধারায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির উত্থাপিত এই প্রস্তাবের উপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংসদ সদস্যরা আলোচনায় অংশ নেন।

মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারকে চাপ দেওয়ার উপর জোর দেন সংসদ সদস্যরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “এ সমস্যা মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে, তাদেরকেই সমাধান করতে হবে।”

সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের সহযোগিতার দরকার হলে প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ তা করবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।

সরকারের কূটনৈতিক উদ্যোগের কথা তুলে ধরতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, “মিয়ানমার সরকারের ধারাবাহিক অপচেষ্টা আমাদের প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে।”

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশে রয়েছে।

এরপর ২০১২ সালে সহিংসতার পর ফের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশমুখী হলে তখন সীমান্তে কড়াকড়ি করে সরকার। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন দীপু মনি। গত বছর একই ধরনের ঘটনা ঘটলেও একই অবস্থানেই থাকে বাংলাদেশ। তার মধ্যেও দুই বারও আরও কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে।

এবার গত ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। দুই সপ্তাহে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩ লাখে পৌঁছে গেছে।

বাংলাদেশ পরিস্থিতি শান্ত করতে এবং রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারে ‘সেইফ জোন’ গড়ে তুলতে প্রস্তাব দিলেও ইয়াঙ্গুন সরকার তাতে সাড়া দিচ্ছে না। উল্টো রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ বলার মাধ্যমে মিয়ানমার বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

রোহিঙ্গা সঙ্কটের পরিস্থিতি বর্ণনা করে বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের পরপরই মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ দিতে সংসদে প্রস্তাবটি গ্রহণ হল।

প্রস্তাবের নোটিসে দীপু মনি মিয়ানমারের দাবি প্রত্যাখ্যান করে নানা ইতিহাস থেকে তথ্য এনে বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেরেই নাগরিক।

“তারা ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আরাকান রাজ্যে বসবাস করছে। চতুর্দশ ও পঞ্চাদশ শতাব্দীতে আরাকান ছিল স্বাধীন মুসলিম রাজ্য। ১৪০৪ সাল থেকে ১৬২২ সাল পর্যন্ত ১৬ জন মুসলিম সম্রাট আরাকান শাসন করেছেন। রাজা বোধাপোয়া ১৭৮৪ সালে আরাকান দখল করে তৎকালীন বার্মার সঙ্গে যুক্ত করেন।”

১৯৪৮ সালে ইউনিয়ন অফ বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের সময়ও আরাকান বা বর্তমানের রাখাইন ওই দেশের অংশ ছিল বলেও সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “১৯৮২ সালের বার্মার নাগরিকত্ব আইন জারির পর রোহিঙ্গাদের তাদের সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।”

রোহিঙ্গা সঙ্কট অবসানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশের কথাও বলেন দীপু মনি; যেখানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিয়ে ফেরত নেওয়ার কথা বলা আছে।  

দীপু মনি বলেন, “ভূমধ্য সাগরে এক আইলানের লাশ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। শত আইলানের ক্ষত-বিক্ষত লাশ আজ নাফ নদীর তীরে ভাসছে। আমরা চাই বিশ্ব বিবেক এগিয়ে আসুক, রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াক।”

রোহিঙ্গা নিপীড়নের জন্য মিয়ানমারে সমালোচনার পাশাপাশি আশ্রয়দাতা হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করছে বিশ্ব। তবে সরকার বরাবরেই বলে আসছে, এই বিশাল সংখ্যক শরণার্থীর ভার বহন করা সম্ভবপর নয়।

সংসদে আলোচনায় বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন ও ভারতকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সমালোচনা করে তিনি বলেন, “শান্তির জন্য নোবেল পাওয়া নেত্রী এত অশান্তি সৃষ্টি করে কীভাবে? ভারত ও চীন তারাও উদ্যোগ নিয়ে আসবেন.. সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন বলে আশা করি।”

রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া বাংলাদেশের জন্য শুভ হবে না বলে বলে মনে করেন রওশন। এজন্য তাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে বলেন তিনি।

শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু মিয়ানমারের সমালোচনা করে বলেন, “রোহিঙ্গাদের শুধু তাড়িয়ে ক্ষান্ত থাকছে না তারা। রোহিঙ্গারা যাতে অক্ষত অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সীমান্তে মাইন পেতে রাখা হচ্ছে।

“এটা শুধু ধর্মীয় বা জাতি নির্মূলের বিষয় হিসেবে দেখলে চলবে না, এর পেছনে রয়েছে বিদেশি শক্তির নানা চক্রান্ত। আরাকান রাজ্য নানা ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীকে উস্কে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন ।”

বিমান মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, “মিয়ানমারে নৃশংস গণগত্যা চালানো হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ যেন আঞ্চলিক ষড়যন্ত্রের শিকার না হয়, সে জন্য আমাদের সচেতন থাকতে হবে।”

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা শরণার্থীদের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার কথা বলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ মিয়ানমারের নেত্রী সু চির ভূমিকর প্রসঙ্গ ধরে বলেন, “তার প্রতি শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু খারাপ লাগে।”

সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেন, “মিয়ানমার কি এতই শক্তিশালী যে পুরো বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাচ্ছে।”