পলায়নপর রোহিঙ্গাদের পেছনে গুলি-আগুন, সামনে মাইন

মিয়ানমারের সেনারা গুলি চালাচ্ছে, জ্বালিয়ে দিচ্ছে ঘর- এসব কথা আগে জানা গেলেও পালিয়ে আসার রোহিঙ্গারা এখন বলছেন সীমান্তে পেতে রাখা মাইনের কথা। 

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Sept 2017, 02:58 PM
Updated : 11 Sept 2017, 04:43 PM

সোমবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আহত রোহিঙ্গা যুবক ইউসুফ নবী (২৮) এবং বাংলাদেশি যুবক মো. হাসান (২৫) স্থল মাইন বিস্ফোরণের শিকার বলে দাবি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ইউসুফের দুই পা উড়ে গেছে।

বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ স্থল মাইন মিয়ানমার সরকার ব্যবহার করছে বলে সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দাবি করার পর তার সমর্থন মিলল আহতদের কথায়।

তবে মিয়ানমার সরকার বরাবরই সীমান্তে স্থল মাইন পুঁতে রাখার কথা অস্বীকার করেছে। দেশটির নেত্রী অং সান সু চির এক মুখপাত্র বলেন, “কে নিশ্চিত করে বলতে পারে যে এসব মাইন সন্ত্রাসীরা পুঁতে রাখছে না।”

সোমবার সকালে চট্টগ্রামে মেডিকেলে গিয়ে আহত আরও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইউসুফের দেখা মেলে। অর্থোপেডিক সার্জারি অ্যান্ড ট্রমাটলজি বিভাগের প্রবেশ পথের পাশেই মাটিতে একটি বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন তিনি।

ইউসুফ মিয়ানমারের আকিয়াবের মংডু থানার রেয়াজউদ্দিন পাড়ার মো. শফির ছেলে।

ইউসুফের সঙ্গে থাকা ছোট ভাই মো. নুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তিন ভাই আসছিলাম। বাড়ি থেকে তিন ঘণ্টার হাঁটলে উখিয়ার পূর্ব দিক।

“আমরা দুইজন আগে হেঁটে আসছিলাম। পেছনে ছিল আরেক ভাই মাহমুদ করিম। হঠাৎ বিস্ফোরণের আওয়াজ পাই। তখন ওই ভাইকে নবী খুঁজতে গেলে আরেকটা বিস্ফোরণ হয়।”

কী বিস্ফোরণ হয়েছিল- জানতে চাইলে নুর বলেন, “মাইন বিস্ফোরণ হয়। মাহমুদ করিম মারা গেছে। নবীকে নিয়ে আমি এপারে চলে আসি।”

আগুন জ্বলছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার গর্জনদিয়া, সারাপাড়া, বড়ডিল ও খোনাকারাপাড়া গ্রামে। সোমবার দুপুর থেকে জ্বলতে দেখা গেছে গ্রামগুলো। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

রোববার সকাল ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটার পর উখিয়ার পূর্ব পাশ দিয়ে আহত ভাইকে নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকেন নুর। কুতুপালং হয়ে রাতে তারা চট্টগ্রামের হাসপাতালে আসেন।

নুর নবীও আহত হয়েছেন। তার ডান হাত ব্যান্ডেজে মোড়ানো। বাম চোখ দিয়ে তখনও রক্ত ঝরছিল। মুখে কয়েক জায়গায় চামড়া উঠে গেছে।

দুই পায়ে আঘাত পাওয়া হাসান বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা আবুল খায়েরের ছেলে।

চমেক পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি সংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় গরু আনতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরেণ হাসান দুই পায়ে আঘাত পান বলে জানিয়েছেন।

ইয়াঙ্গুন সরকার অস্বীকার করলেও দুই দেশের যৌথ সীমান্তে মিয়ানমার স্থলমাইন পুঁতে রাখছে বলে দেশটির সরকারের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ইতোমধ্যে করেছে বাংলাদেশ সরকার।

মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইনের এই ছবিটি প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল

অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, গত সপ্তাহে সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের একটি গ্রামে আরও চারটি বিস্ফোরণে একজন নিহত এবং দুই কিশোর আহত হয়।

গত ৩ সেপ্টেম্বর বিস্ফোরণে পঞ্চাশোর্ধ এক নারীর পায়ের জখম পরীক্ষা করে মানবাধিকার সংগঠনটি জানায়, ক্ষতের ধরন থেকে চিকিৎসকরা বলেছেন, এটা বিস্ফোরক কোনো কিছুর কারণেই ঘটেছে, যা শক্তিশালী ও ভূমি থেকে উপরের দিকে বিস্ফোরিত হয়েছে। যা ভূমি মাইনের কারণে হয়ে থাকে।

অ্যামনেস্টির অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ, এসব ঘটনায় ব্যবহার করা অন্তত একটি মাইন পিএমএন-১ স্থলমাইন বলে চিহ্নিত হয়েছে, যা সাধারণত জখম করার জন্যই তৈরি করা হয়।

 

গত ২৫ অগাস্ট সহিংসতা শুরুর পর থেকে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গারা বলছেন, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সৈন্যরা তাদের নির্বিচারে হত্যা করছে, জ্বালিয়ে দিচ্ছে ঘর।

গুলি ও আগুনের ক্ষত নিয়ে অনেকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদেরই একজন মিয়ানমারের বুজি ডং এর থাম বাজার এলাকার মো. সোয়েবের নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে উম্মে সালমা।

বাম উরুতে গুলিবিদ্ধ উম্মে সালমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাড়িতে আগুন দেওয়ার পর দুই ভাই, এক বোন আর মা-বাবা সবাই পালিয়েছেন।

“১০ দিন পাহাড়ে পাহাড়ে হেঁটেছি। তারপর একটা নৌকায় ছোট ছোট খাল পেরিয়ে আসি। পার হওয়ার (সীমান্ত) আধা ঘণ্টা আগে পায়ে গুলি লাগে। মা’র পায়েও গুলি লেগেছে।”

কক্সবাজারের কোনো স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও এর নাম জানাতে পারেনি উম্মে সালমা।

পলায়নপর রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীদের গুলিবর্ষণের খবর এর আগেও এসেছে।

এই দফায় এরই মধ্যে ৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের আপাতত রাখার জন্য কক্সবাজারের বালুখালীতে আশ্রয় কেন্দ্র হয়েছে।

সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে বাম পায়ে গুলি লেগে আহত হন মিয়ানমারের বুজিডং এলাকার নবম শ্রেণির ছাত্রী উম্মে সালমা। ছবি: সুমন বাবু

উম্মে সালমা জানায়, নৌকায় সীমান্ত পারাপারের জন্য নৌকার মাঝিকে তিন আনা স্বর্ণ দিতে হয়েছে।

মংডুর তুলাতলী এলাকার বাসিন্দা জাফর আলম (২৫) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঈদের তিন দিন আগে তাদের বাড়িতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হামলা চালায়।

বাম হাতের কনুইতে গুলিবিদ্ধ জাফর পালিয়ে উখিয়া আসেন। পাঁচ দিন আগে তিনি চমেক হাসপাতালে ভর্তি হন।

জাফর বলেন, “কোরবানির তিন দিন আগে আর্মি বাড়িতে আগুন দেয়। বাড়ি থেকে লোক বেরিয়ে যাওয়ার সময় গুলি করে। আমার মা, দুই ভাই, এক ভাবি আর ছয়জন ভাতিজা গুলিতে মারা গেছে। ছয় ভাতিজার বয়স ১২ বছরে থেকে তিন মাস।”

পরিবারের অন্য সদস্যদের কেউ বালুখালী ক্যাম্পে আবার কেউ সায়েরখালী এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে বলে জানান জাফর।

মিয়ানমারে সেনা অভিযানের সময় গুলিবিদ্ধ হন মংডুর তুলাতলি এলাকার জাফর আলম; সেনাবাহিনীর গুলিতে তার পরিবারের ১০ জন মারা গেছেন বলে জানান তিনি। ছবি: সুমন বাবু

হাসপাতালে জাফরের দেখাশোনা করছেন তার ভাই রহমত উল্লাহ; তিনি ২০১২ সালে বাংলাদেশে এসেছেন।

রহমত উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১২ সালে এলাকার মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয় মিয়ানমার সরকার। তখন তিনি চট্টগ্রামের রাহাত্তার পুল মজিদিয়া মাদ্রাসায় এসে আলিমে ভর্তি হন।

চমেক পুলিশ ফাঁড়ির তথ্য মতে, মিয়ানমার থেকে আসা গুলি, বোমা, মাইনের আঘাতসহ অসুস্থ অবস্থায় সোমবার পর্যন্ত মোট ৯৩ জন রোহিঙ্গা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

এদের মধ্যে মারা গেছেন দুই জন। সুস্থ হয়ে চলে গেছেন ১১ জন এবং কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন একজন। বাকি ৭৯ জন চিকিৎসাধীন।