রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে ৩ চ্যালেঞ্জ

অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও সে কাজটি কঠিন বলে মনে করছেন বাংলাদেশিদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাজ করে যাওয়া নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Sept 2017, 06:17 AM
Updated : 9 Sept 2017, 01:28 PM

নতুন-পুরনো মিলিয়ে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার কোনো তথ্যভাণ্ডার না থাকাটাই বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

রোহিঙ্গা  শুমারির একটি প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন মনে করেন, রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিরূপণ, কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে ডেটাবেইজ তৈরি এবং রোহিঙ্গা পরিবারগুলো খুঁজে বের করাই বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের বড় তিন চ্যালেঞ্জ।

প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে চার দশক আগে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের শুরু। তারপর বিভিন্ন সময়ে অনুপ্রবেশ ঘটতে ঘটতে এই সংখ্যা ৫ লাখে দাঁড়ায়।

সম্প্রতি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মুখে নতুন করে উদ্বাস্তদের ঢল নামে বাংলাদেশ পানে। নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৩ লাখের কাছে পৌঁছে গেছে বলে জাতি সংঘের হিসাব।

এই দফায় প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা ঢুকেছে বাংলাদেশে

বাংলাদেশে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির রয়েছে তিনটি; এগুলোতে ৩০ হাজারের মতো নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে। বাকি সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম জেলা থেকে শুরু করে দেশের নানা প্রান্তে।

আশ্রয় পেতে বাংলাদেশে আসা এই রোহিঙ্গারা পরিচয় গোপন করে ভোটার হয়েছেন বলে যেমন তথ্য পাওয়া গেছে; তেমনি অনেকে পাসপোর্ট করে বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন।

উদ্বাস্তু এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে বলে সরকারের ভাষ্য।

এই কারণে উদ্বেগ থেকে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধন ঠেকাতে সজাগ রয়েছে নির্বাচন কমিশন, যারা বাংলাদেশের ১০ কোটির বেশি ভোটারের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদেরও বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে শুক্রবার কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

তিনি বলেন, নতুন ও পুরনো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় নিয়ে এসে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে একটি ডেটাবেইজও তৈরি করা হবে।

জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য চোখের আইরিশের ছাপ নেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশিদের

ইসি বাংলাদেশের নাগরিকদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আগে তাদের তথ্য নিয়ে তথ্যভাণ্ডার তৈরি করে। এরপর হাতের ১০ আঙুল ও চোখের আইরিশের ছাপ নেয়।

দেশের নাগরিকদের নিয়ে এ কারিগরি কাজটি করতে যেখানে ইসিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মিয়ানমারের এই নাগরিকদের সুশঙ্খলভাবে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনা কঠিন বলছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোহিঙ্গারা এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় তাদেরকে জড়ো করে কাজটি করা বেশ জটিল।”

তিনি বলেন, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাজটি করবে মূলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেবা ও সুরক্ষা বিভাগ; এ কাজে পাসপোর্ট অধিদপ্তরও কাজ করবে। একাজে সম্পৃক্ত হতে ইসি সরকারকে প্রস্তাব দেবে।

কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে আগে থেকে থাকা রোহিঙ্গারা

ইতোমধ্যে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তত্ত্বাবধানে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে একটি শুমারি হয়েছে। ছবিসহ ৪৬টি তথ্য নিয়ে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের ‘ডেটাবেইজ’ তৈরি হয়েছে। তবে তাদের কোনো বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হয় নি।

সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীতে থাকা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিরূপণ করা হয় এই প্রকল্পের আওতায়।

পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল টাস্কফোর্সের অধীনে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এ প্রকল্পের শুরুতে রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি।

এ অবস্থায় পুরনো ও নতুনদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক আলমগীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিদ্যমান অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নতুনদের সংখ্যা নিরূপণ ও বায়োমেট্রিক নিবন্ধন বেশ বড় চ্যালেঞ্জ।

তার মতে, রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাজে অন্তত তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

“সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিদেশি নাগরিকদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আগে কোথায়, কীভাবে, কত সংখ্যক রয়েছে তার সংখ্যা নিরূপণ; কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে ডেটাবেইজ করা ও নিবন্ধনের ডিভাইস সরবরাহ; রোহিঙ্গা সদস্যদের ফ্যামিলি ট্র্যাকিং- নিবন্ধনের এই তিনটি বড় কাজ।”

শুমারির অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আলমগীর বলেন, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের তথ্য সংগ্রহ করা সহজ হবে না। কারণ, তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি রয়েছে তথ্য দিতে। ক্যাম্পের বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কেন্দ্রে আনাটা বেশ কঠিন। আবার এদের পরিবারের সব সদস্যকে একসঙ্গে পাওয়াও দুষ্কর।

শিশুদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের জটিলতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “নয় বছরের কম বয়সীদের আঙুলের ছাপ পরবর্তীতে পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে চোখের আইরিশ নেওয়াটা কাজে দেবে।”

বাংলাদেশ পানে নতুন করে রোহিঙ্গা স্রোত

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) তথ্য অনুযায়ী, কুতুপালং ও নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে নিবন্ধিত ৩০ হাজারসহ দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এস এম রেজওয়ান হোসেন গত ২৬ অগাস্ট চট্টগ্রামে এক সভায় বলেছিলেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা কোনো ধরনের সেবা নিলে বা অনুপ্রবেশের সময় তাদের ‘বায়েমেট্রিক ডেটা’ নেওয়া গেলে ভালো হয়।

অনেকে নিজেদের জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ ও অন্যান্য কাগজপত্র ভোটার হওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করছে বা ভাড়া দিচ্ছে বলেও ওই বৈঠকে জানান তিনি।

সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে ভুয়া জন্মসনদ ইস্যু করা বা বাবা-মা হিসেবে ভুয়া পরিচয় দাখিল বন্ধে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে একটি আধা সরকারি পত্র জারি করা হবে। এছাড়া সহযোগিতাকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক করে চিঠি পাঠানো হবে।