ষোড়শ সংশোধনী: সেই রায় নতুন করে লেখার পরামর্শ সাবেক বিচারপতির

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ যে জটিলতার মধ্যে পড়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে ওই রায় নতুন করে লিখতে আপিল বিভাগকে পরামর্শ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক একজন বিচারক।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Sept 2017, 04:55 PM
Updated : 7 Sept 2017, 07:48 AM

ওই রায়ের বিশদ বিশ্লেষণ করে লেখা এক নিবন্ধে বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশিদ বলেছেন, “এটা মানতে হবে যে, আপিল বিভাগের ওই রায় পুরো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। পুরো জাতি এখন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, ক্ষোভ প্রকাশ করছে, যার যার মত করে অভিযোগ করছে।”

ষোড়শ সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ওই সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করায় রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে তুমুল আলোচনা। 

আইন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ গত ১ অগাস্ট প্রকাশিত ওই রায়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। ইংরেজিতে লেখা তার নিবন্ধটি কেবল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত হচ্ছে তিনটি পর্বে। প্রথম পর্বটি ইন্টারনেটে আসছে বৃহস্পতিবার প্রথম প্রহরে

তিনি লিখেছেন, “যথেষ্ট হয়েছে! এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়, সেটাই এখন প্রশ্ন।”

সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিজের হতাশা প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের এই সাবেক বিচারক।

“আইনজীবী সমিতি দলীয় মেরুকরণে বিভক্ত। সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। লিগ্যাল কমিউনিটিতে এমন কোনা অভিভাবক দেখা যাচ্ছে না যিনি জাতিকে এই অচলাবস্থা থেকে বের করে আনতে পারেন।”

ফলে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারকদেরই এখন জাতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করছেন বিচারপতি আবদুর রশিদ। আর সেই সমাধানও তার ভাষায় ‘খুব বেশি কঠিন নয়’।

“উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্বটা সরকারের। ন্যায়চারের স্বার্থে ওই রায় যে কোনো সময় পুনর্বিবেচনা করা যায়; সংসদ ও বিচার বিভাগের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে নতুন করে লেখা যায়।”

সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশিদ

তিনি লিখেছেন, একটি সংসদ এক দিনে তৈরি হয় না। সংসদ দৃঢ় ভিত্তি পাওয়ার জন্য জনগণের সমর্থন, শ্রদ্ধাবোধ এবং ত্যাগের প্রয়োজন হয়।

“পার্লামেন্টকে নির্দেশনা দিয়ে বিচার বিভাগ এমন আচরণ করছে, যেন তারা সংবিধানের আওতা বহির্ভূত কোনো কর্তৃপক্ষ। মনে রাখতে হবে, যে সার্বভৌম জনগণ নির্দিষ্ট সময় পর পর সংসদ নির্বাচিত করে, সেই জনগণকে আদালতের কোনো নির্দেশনা দিয়ে বাধ্য করা যায় না।

“আপিল বিভাগের রায়ের কার্যকারিতা বিলোপ করে সংসদ যে কোনো আইন তৈরি করতে পারে।” 

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে সংসদের হাতেই ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সময়ে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে তা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়। পরে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিলেও আপিল বিভাগের রায়ে তা বাতিল হয়ে যায়।

ষোড়শ সংশোধনীকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে ওই রায়ে বলা হয়, ওই সংশোধনীর আগে যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যবস্থা ছিল, তা পুনঃস্থাপিত হল।

কোন ধরনের অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে একজন বিচারককে অপসারণ করা হবে তা নির্ধারণের জন্য ৩৯ দফার নতুন একটি আচরণবিধিও যুক্ত করে দেওয়া হয় রায়ে।

সাত বিচারপতির ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেওয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার এই রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন।

ওই রায় এবং পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এ রায় ‘ঐতিহাসিক’।

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকও আপিল বিভাগের রায়কে ‘ভ্রমাত্মক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

তিনি বলেন, “আমরা এতকাল জেনে এসেছি, দিস ইজ পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ, কিন্তু এ রায়ের পরে মনে হচ্ছে, উই আর নো লংগার ইন দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। উই আর রাদার ইন জাজেস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ।”

খায়রুল হকের আগে ২০০৯ সালের এপ্রিল থেকে ১৮ মাস আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন হাই কোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশিদ। 

ষোড়শ সংশোধনীতে প্রতিস্থাপিত ৯৬ অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করে বিচারপতি রশিদ বলছেন, ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদ নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে বলে যে ধারণা দেওয়া হয়, তা সঠিক নয়। বিচারক অপসারণের কোনো ক্ষমতা সেখানে সংসদকে দেওয়া হয়নি। 

প্রতিস্থাপিত ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ দফায় স্পষ্ট বলা হয়েছে- “প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।”

তার ৩ দফায় বলা হয়েছে, “দফা-২ এর অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবে।”

বিচারপতি রশিদ বলছেন, এখানে সংসদ দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কেবল একটি প্রস্তাব পাস করতে পারে এবং তা রাষ্ট্রপতিকে পাঠাতে পারে। আর এ কাজটি সংসদ করতে পারে তখনই, যখন একটি সংবিধিবদ্ধ কমিটির তদন্তে কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য প্রমাণিত হয়।   

“এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে ওই সংবিধিবদ্ধ কমিটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের চেয়ে কম প্রতিনিধিত্বমূলক, কম স্বাধীন বা কম শক্তিশালী হবে। ওই সংবিধিবদ্ধ কমিটি যদি কোনো পদাধিকারীর দোষ খুঁজে না পায়, তাহলে তাকে অপসারণের প্রস্তাব নিয়ে এক ইঞ্চি অগ্রসর হওয়ার সুযোগও সংসদের নেই।    

বিচারপতি রশিদ লিখেছেন, সেই তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি এবং অপসারণের প্রক্রিয়া ঠিক করে আইন তৈরির আগেই তাড়াহুড়ো করে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা একটি ‘অপরিপক্ব’ সিদ্ধান্ত।

ষোড়শ সংশোধনীতে ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে বলে যে ধারণা দেওয়া হয়, তার পক্ষে কোনো সমর্থন সংবিধানে পাওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক এই বিচারক।

তিনি লিখেছেন, আপিল বিভাগ যেভাবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সেই জায়গায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল করেছে, তাও সংবিধান সমর্থন করে না।

“সংবিধানে নেই এমন কিছু সংবিধানে লিখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিজে থেকে নেওয়ার কোনো এখতিয়ার সংবিধানে আপিল বিভাগকে দেওয়া হয়নি। প্রধান বিচারপতি যেভাবে ভালো মনে করেন, সেভাবে সংবিধানের কোনো কিছু সংশোধন বা নতুন করে লিখে দেওয়ার এখতিয়ারও তাকে সংবিধান দেয়নি।”

বিচারপতি রশিদ বলছেন, “সংবিধানের অধীনে কেবল সংসদ ছাড়া আর কারও সংবিধানে কোনো পরিবর্তন আনার এখতিয়ার নেই। সেই এখতিয়ার আছে বলে মনে করাটাও সংবিধানের লঙ্ঘন।”  

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা (ফাইল ছবি)

নিবন্ধে বলা হয়েছে, ওই রায়ের মূল অংশে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২, ৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর ধারা সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পুনঃস্থপিত করার কথা বলা হয়েছে। এই ধারণার ভিত্তিতে তা করা হয়েছে যে, কোনো আইনের একটি সংশোধনী যদি বাতিল করা হয়, তাহলে আগের মূল আইনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃস্থপিত হবে। কিন্তু সংবিধানের ক্ষেত্রে এই নিয়ম খাটে না।

“সংবিধানের কোনো একটি অংশ বাতিল বা সংযোজন-বিয়োজনের কাজটি ১৪২ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী করতে পারে কেবলমাত্র সংসদ।”

আর মামলার বিষয়বস্তু না হওয়ার পরও ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে যেভাবে বিচারকদের জন্য ৩৯ দফার আচরণবিধি করে দেওয়া হয়েছে, তার প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিচারপতি রশিদ। 

“২০০০ সালের ৭ মে প্রকাশিত ১৪ দফার কোড অব কনডাক্ট সংশোধন করে নতুন কোড অব কনডাক্ট তৈরি করতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠকের প্রয়োজন ছিল। বৈঠক না করে কীভাবে তা করা হল, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি রায়ে।”

রায়ে সংবিধানের সঙ্গে এসব অসঙ্গতি কেমন করে বাকি ছয় বিচারকের নজর এড়িয়ে গেল, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন হাই কোর্ট থেকে ২০০৯ সালে অবসরে যাওয়া বিচারপতি আবদুর রশিদ।

নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের ক্ষমতা সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়ার বিধান সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।

বিচারপতি রশিদের ভাষায়, ওই পর্যবেক্ষণ ‘দুর্ভাগ্যজনক’।

ওই অনুচ্ছেদ নিয়ে হাই কোর্টে একটি রুল নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।এই অবস্থায় হাই কোর্ট যদি প্রধান বিচারপতির ওই পর্যবেক্ষণে প্রভাবিত হয়, তা একটি বাজে নজির হবে বলে সাবেক এই বিচারক মনে করেন।

নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, “এ বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে হাই কোর্ট বা আপিল বিভাগের কোনো রায় সাংবিধানিকভাবে সংসদকে কোনো পরিবর্তন আনতে বাধ্য করতে পারে না।

“কোনো রায় আমলে নিয়ে সংবিধানে কোনো পরিবর্তন করা হবে কি না তা সংসদই ঠিক করবে। সংসদীয় বা রাষ্ট্রপতিশাসিত- যে কোনো ধরনের গণতন্ত্রের জন্যই এটা সমান সত্যি।”