চাঞ্চল্যকর এ মামলায় আসামিদের আপিলের রায়ে মঙ্গলবার নূর হোসেন ও সাবেক তিন র্যাব কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের হাই কোর্ট বেঞ্চ।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট বলেছে, “আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, যদি তারা ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে।”
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ ডুবিয়ে দেওয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে।
ওই মামলার রায়ে চলতি বছর ১৬ জানুয়ারি ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন।
আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে মঙ্গলবার হাই কোর্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। ১১ জনের সাজা কমিয়ে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। নয়জনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়।
র্যাবের তখনকার ক্যাম্প কমান্ডার আরিফ হোসেন ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন মেজর। আর মাসুদ রানা ছিলেন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন সশস্ত্র ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্য।
জজ আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের সঙ্গে আসামি নূর হোসেনের দ্বন্দ্বের জেরেই সাত খুনের ঘটনা ঘটে।
“এটি একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর কিছু সংখ্যক দুস্কৃতকারী ও কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক বা সন্ত্রাসীদের দ্বারা সংঘটিত ঘটনা। এখানে নূর হোসেন একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও গডফাদার। নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামও সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। একজন প্যানেল মেয়র নজরুলকে হত্যা করতে গিয়ে নিরীহ ছয়জন মানুষ এই সকল র্যাব ও নূর হোসেন বাহিনীর দ্বারা নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন।”
আর হাই কোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “নূর হোসেনের সঙ্গে সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক মেজর আরিফ হোসেন ও সাবেক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানার অবৈধ অর্থিক লেনদেন হয়েছিল। তবে এই নূর হোসনই হল এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড।”
হাই কোর্ট বলেছে, র্যাব রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বিশেষ বাহিনী। তাদের দায়িত্ব হল জনগণের জানমাল রক্ষা করা এবং নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু এ বাহিনীর কিছু সদস্য নৃসংশ হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পরে অপরাধ ঘটিয়েছে। ফলে তাদের বিচার হয়েছে।
“কিছু উচ্ছৃঙ্খল র্যাব সদস্যের কারণে এ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে না। তাদের সন্ত্রাসবিরোধী গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ধূলিস্যাৎ হতে পারে না। কিন্তু এই বাহিনীর কতিপয় সদস্যের অপরাধবৃত্তি মানব সভ্যতায় আতঙ্কজনক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তারা এতটাই পাশবিকতা দেখিয়েছে, যা ছিল নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চ প্রকাশ।”
“র্যাব সদস্যরা এতটাই নির্দয় ছিল যে, হত্যার পর তাদের তলপেট ছুরি দিয়ে কেটে বস্তাবন্দি করে তার সঙ্গে ১০টি করে ইট বেঁধে দেওয়া হয়, যেন বস্তাবন্দি লাশ নদীর পানিতে তলিয়ে যায়।”
আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে উদ্ধৃত করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এই হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। তাদের নৃসংশতা প্রমাণ করে, মৃতদেহের উপরও তারা কতটা নির্দয় ছিল।
আসামিপক্ষ শুনানিতে দাবি করে, এ মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী কোনো সাক্ষ্য নেই, আর্থিক লেনদেনেরও কোনো প্রমাণ নেই।
এ বিষয়ে হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “র্যাবের তখনকার এডিজি জিয়াউল হাসান টাকা লেনদেনের বিষয়ে মেজর আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এছাড়া নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম তারিক সাঈদের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, নূর হোসেন যত টাকা দিয়েছে তার চেয়ে বেশি টাকা দেবেন, নজরুলকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়।
“এ থেকে প্রমাণ হয়, টাকার বিনিময়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তাছাড়া বেআইনি লেনদেনের সাধারণত কোনো প্রমাণ থাকে না।”
১১ জনের সাজা কমানোর বিষয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “অপরাধের ধরন বিবেচনায় নিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। অপরাধের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা হয়েছে। কিন্তু তারা যে অপরাধ করেছে, তাতে যাজজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে তা হত কঠোর শাস্তি।”
র্যাবের কয়েকজন সদস্য অপরাধ করলেও নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে এ বাহিনীর ওপর দেশের মানুষের ‘যথেষ্ট আস্থা’ রয়েছে মন্তব্য করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “কতিপয় সদস্যের কারণে সামগ্রিকভাবে গোটা বাহিনীকে দায়ী করা যায় না।”